দক্ষিণ ফ্রান্সের ওয়েস্টার সংস্কৃতি (Oyster Farming in Arcachon Basin, France)

ফরাসীদের খাওয়া দাওয়া, বিশেষ করে শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি খাওয়া নিয়ে ব্রিটিশ মিঃ বিন বা আমেরিকান লুসি যতই কৌতুক করুক না কেন, ফরাসীদের কাছে কাঁচা ওয়েস্টার একটু লেবুর রস দিয়ে খাওয়া মানে – kissing the sea on the lips।

রোমান যুগ থেকেই ফরাসী মেনুতে ওয়েস্টার যোগ হয়েছিল আর, তারপর থেকেই ফরাসীরা কিন্তু ফ্রান্সের নানান উপকূলবর্তী এলাকা থেকে খুবই ভালো প্রজাতির ওয়েস্টার উৎপাদন করে এসেছে। তাই, ওয়েস্টার খাওয়া ও চাষ করাকে ওরা বহু আগে থেকেই খুবই গুরুত্ব দিয়ে এসেছে – এবং ইউরোপের প্রথম দেশ, যে কিনা বৈজ্ঞানিক উপায়ে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে, বহুল পরিমাণে ওয়েস্টার চাষ করার প্রকল্প নিয়েছিল। আর সমুদ্রের তীরে ওয়েস্টার চাষ করার পদ্ধতিকে ফ্রান্সে L’ostréiculture বলে, এবং যারা ওয়েস্টার চাষ করে তাদের বলা হয় –  Ostréiculteurs ।

উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, নেপোলিয়ান থার্ড দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের Arcachon Basin  এ অ্যাটল্যান্টিকের তীরে প্রথম বানিজ্যিক ওয়েস্টার ফার্ম স্থাপন করেছিলেন।

আর বর্তমানে এই ছোট্ট অঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিনশো ওয়েস্টার চাষি মিলে, বছরে আট থেকে দশ হাজার টন ওয়েস্টার উৎপাদন করে, ফ্রান্সের অর্থনীতির এক ছোট্ট অংশ ওয়েস্টার উৎপাদনই দখল করে নিয়েছে বলা যায়।

আর, ফ্রান্সে যত ওয়েস্টার উৎপাদন হয়, তার আশি শতাংশ ওয়েস্টার ফরাসীরা নিজেরাই খেয়ে নেয়, তাও আবার টাটকা তাজা, কাঁচা কাঁচা। সরাসরি সমুদ্র থেকেই যাতে ফরাসীদের প্লেটে চলে আসে, তার জন্যে যত রকমের ব্যবস্থা নেওয়া যায় – ফরাসীরা সেটা নেয়।

তাই, দক্ষিণ ফ্রান্সের Arcachon  Basin এর দিকে গেলে, দূর থেকেই দেখা যায় – অ্যাটল্যান্টিক সমুদ্রের তীরে সারি সারি বাঁশ কিংবা কাঠের লাঠি পুঁতে রাখা, কাছে গেলেই দেখা যায় প্রত্যেকটা লাঠিতে ছোট ছোট শামুক, ঝিনুক আশ্রয় নিয়েছে। আর Arcachon  এর সমুদ্রের তীরে সারি সারি রেস্টুরেন্টে শুধুই ওয়েস্টারের নানা পদ এবং টাটকা তাজা কাঁচা ওয়েস্টার পরিবেশন করা চলছে।

কিন্তু, যেখানে সমুদ্র দূষণ নিয়ে পৃথিবীর চারিদিকে যত আলোচনা চলছে, তাতে সরাসরি সমুদ্র থেকে তুলে নিয়ে কাঁচা ওয়েস্টার খেয়ে নেওয়ার মধ্যে অন্য কোন বিপদের আশংকা নেই তো?

উত্তরে, ফরাসী সমুদ্র ও ওয়েস্টার বিজ্ঞানীরা বলে – ওয়েস্টার দূষিত সমুদ্রের জলে বাঁচতে পারে না। সাধারণ এক স্বাস্থ্যকর ওয়েস্টারের বেড়ে ওঠা, সমুদ্রের জলে নুনের পরিমাণ, তাপমাত্রা, হাওয়া, ইত্যাদি থেকে শুরু করে, সমুদ্র দূষণের পরিমাণ ও আরও অনেক কিছুর উপরে নির্ভর করে। তাই ফ্রান্সের ওয়েস্টার চাষের সমুদ্র এলাকাকে সর্বদা পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়।

তাছাড়া, রোমান যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত – এই দীর্ঘ সময়ে ফ্রান্সের ওয়েস্টার চাষিরা ফরাসীদের এই প্রিয় খাদ্যকে উৎপাদন করার জন্যে ধীরে ধীরে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ওয়েস্টার চাষের পদ্ধতি শিখে নিয়েছে, আর আজ ফ্রান্সের যে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা দাবী করে – ফ্রান্সকে ওয়েস্টার চাষে কেউই হারাতে পারবে না, কারণ ওরা savoir faire বা এক্সপার্ট।

তাই ফ্রান্সের সমুদ্র তীরের যে সমস্ত রেস্টুরেন্টে ওয়েস্টার পরিবেশন করা হয়, তাদের চোখে মুখে এক গর্ব, এক আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া দেখা যায় – যেন ওরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো খাদ্যটি পরিবেশন করছে।

গত কয়েক শতাব্দী জুড়ে ওয়েস্টারের সঙ্গে ফরাসীদের এতোই রোম্যান্টিক ও সাংস্কৃতিক এক যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে, বছরের বিশেষ এক সময় এলে ওয়েস্টারের স্বাদের মোহ থেকে ওরা কিছুতেই দূরে থাকতে পারে না।

অক্টোবর, নভেম্বর মাসে যখন ফ্রান্সের প্রায় প্রত্যেকটা গাছের পাতা হলুদ – কমলা রং ধরে, হাওয়ায় এক শিরশিরে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভূতি বলে দেয় শীতের আগমনী বার্তা, ফরাসী ওয়েস্টার ফার্মাররা স্থানীয় বাজারে নানা ধরণের ওয়েস্টারের পসার সাজিয়ে বসে। ফরাসীদের ক্রিসমাস মানেই ওয়েস্টার খাওয়া।

তাই, ফরাসীদের ওয়েস্টার খাওয়া নিয়ে যে যতই কৌতুক করুক না কেন, ফরাসী ওয়েস্টার চাষি থেকে শুরু করে, ফরাসী সমুদ্র বিজ্ঞানীরা ওয়েস্টার ব্যবসাকে খুবই গুরুত্ব দেয়, আর সাধারণ ফরাসীরাও কিন্তু ওয়েস্টার খাওয়াকে এক জাতীয় গর্বের পর্যায়েই রেখেছে।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel, Western-Europe and tagged , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s