প্রাগের চার্লস ব্রিজ। প্রচুর মানুষের উপস্থিতি, আসা যাওয়া, চলাফেরা – তবুও সন্ধ্যে নামার ঠিক আগে চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা জড়িয়ে রয়। যেন প্রাচীন এই সেতুর সন্ধ্যার প্রস্তুতিকে সম্মান জানিয়ে এখানের টুরিস্টরা সবাই চুপচাপ থাকতেই বেশী পছন্দ করে।
এদিকে, সেতুর নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাগের ভালতাভা নদী, প্রাগ শহরের আবীর রাঙা পশ্চিম আকাশ, প্রাগের মানুষের ঘরে ফেরা ও সিগালের দিনের শেষ মাছ শিকার সেরে নেওয়া ও চিৎকার করতে করতে একপাক আকাশে ঘুরপাক খেয়ে সেতুর নীচে, কিংবা স্ট্যাচু গুলোর উপরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যাওয়া – এই সব নিয়েই প্রাগ সন্ধ্যার প্রস্তুতি চলে, ফুটে ওঠে প্রাচীন প্রাগ শহরের এক শান্ত ছবি।
আর সেই ছবির ফ্রেমে যখন মগ্ন ছিলাম, ঠিক তখুনি দেখি, এক চেক্ ভদ্রলোক, চার্লস ব্রিজের এক কোণে দাঁড়িয়ে প্রচুর ওয়াইনের গ্লাস সাজিয়ে রাখতে শুরু করেছে, তারপর, একে একে প্র্যতেকটা গ্লাসে একটু একটু করে জল ভরতে শুরু করেছে। অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে মেপে মেপে ওয়াইন গ্লাস গুলোতে জল ভরছে – কখনো কোন গ্লাসে জল বেশী ভরা হয়ে গেলে সন্তর্পণে কমিয়ে দিচ্ছে।
ওর এই জল মাপামাপির খেলা অনেকেই দূর থেকে লক্ষ্য রাখছিল, কেউ কেউ তো আবার ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। প্রাগের এই চার্লস ব্রিজের ওপারে রক্তিম আলোয় রাঙ্গানো শেষ বেলার মোহময় দৃশ্যের হাতছানি, যার সাক্ষী হতে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ প্রাগে আসে, এমনি এক প্রাগ সন্ধ্যা হয়তো টুরিস্টদের জীবনে বার বার আসে না, সেই অপূর্ব সন্ধ্যার অপূর্ব রূপের দিকে মানুষটার কিন্তু বিন্দু মাত্র লক্ষ্য নেই – সে একান্ত মনে তার গ্লাস গুলোয় জল ভরে চলেছে।
একে একে সমস্ত গ্লাসে তার পছন্দের অনুপাতে জল ভরা শেষ হলে, ভদ্রলোক তাকে ঘিরে সমবেত মানুষদের দিকে তাকাল। অনেকেই তার জল ভরার মনোযোগ দেখে কৌতূহলী হয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়াতে শুরু করছিল, প্রাগের চার্লস ব্রিজে সন্ধ্যার অপেক্ষায় সমবেত ভিড়ে আমারাও ছিলাম, তাই, আমাদেরও কৌতূহল উপছে পড়ছিল – কে ও? কি করবে?
আর ভদ্রলোক সেই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে স্পষ্ট ইংরেজিতে ভদ্রলোক বললেন – এই অর্ধেক জল ভরা গ্লাসে আঙ্গুল বুলিয়ে আমি তোমাদের বাখ্-এর এক সুর শোনাবো। একটু কাছে এগিয়ে এসো।
আমাদের মতো অনেকেরই সেই কথাটা বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছিল – তবুও কৌতূহলী ভিড় এগিয়ে গেল তার কাছে। ধীরে ধীরে ভদ্রলোক অর্ধেক জল ভরা গ্লাস গুলোয় আঙ্গুল বোলাতে শুরু করলেন – চার্লস ব্রিজে এক সুর লহরী ছড়িয়ে পড়ল। চার্লস সেতুর সেই ঐতিহাসিকতা, রক্তিম সন্ধ্যার সজ্জা, সুরের যাদু – সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল, আর সেই পরিবেশের যাদু যেন উপস্থিত সবাইকেই সম্মোহিত করে দিল।
পরে জানলাম, গ্লাসে অর্ধেক জল ভরে, আঙ্গুল বুলিয়ে বুলিয়ে, এই ধরণের সুর তোলার পদ্ধতির সূচনা, ইউরোপে বহু আগেই হয়েছিল। আঠারো শতাব্দীর শুরুর দিকে দক্ষিণ জার্মানিতে প্রথম এই গ্লাস হারপের সূচনা হয়েছিল, তারপর সেই সময় প্রায় সমস্ত ইউরোপেই এই অদ্ভুত গ্লাস মিউজিকের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এমনকি, মোজার্টও নাকি, গ্লাস হারপের জন্যে সুর তৈরি করেছিলেন।
বর্তমানে, এই শিল্প প্রায় লুপ্ত, ইউরোপে হাতে গোণা কয়েকজনই নাকি এই গ্লাস হারপ বাজায়। হয়তো, গ্লাস হারপের শেষ সূত্রটুকুকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় ভদ্রলোক, চার্লস ব্রিজের আন্তর্জাতিক ভিড়ে গ্লাস হারপে সুর তোলেন, পৃথিবীর নানা প্রান্তে তার বাজানো সুরকে বয়ে যেতে দেন।
অর্ধেক জল ভরা গ্লাস দেখিয়ে অনেককেই জীবন দর্শন বোঝাতে শুনেছি – কারোর মতে গ্লাস অর্ধেক খালি, কারোর মতে গ্লাস অর্ধেক ভরা – জীবনকে কে কি ভাবে দেখে – সেই দর্শন, কিন্তু, কেউ তো আগে আমাদেরকে অর্ধেক গ্লাস দেখিয়ে বলে নি – দেখো, এই অর্ধেক জল ভরা গ্লাসে আমি বাখ্ বা মোজার্টের সুর শোনাবো! তাই আশ্চর্য হই।