দক্ষিণ ফ্রান্সের তুলুস শহরের সঙ্গে যে নদীটি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকে, নাম তার গারন। এই গারন নদীকে দেখেছি বহু রূপে – কখনো তুষারপাতে নিঝুম গারন, কখনো বৃষ্টি ভেজা গারন, কখনো বৃষ্টির পরে ফুলে ফেঁপে ওঠা উত্তাল গারন, আবার কখনো ধীর শান্ত গারন।
সামারে আবার এই গারন নদীর তীরে নানা ধরণের খেলা, ওপেন এয়ার কনসার্ট, নানান ওয়াটার স্পোর্টসের আয়োজন করা হয়, তাই গরমের সময়ে গারন নদীর তীর তুলুস বাসীর এক বিনোদনের ঠিকানা। কিংবা গারন তীরের পাথরে বাঁধানো রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে, বা, গারনের বুকে নৌকো ভ্রমণ করতে করতে এই নদী ও তুলুসের আকাশ রেখার ওপারে রক্তিম সূর্যাস্ত দেখা যায়, দেখা যায় এই লাল ইটের শহরের বুকে সন্ধ্যা নামার তোড়জোড়।
দক্ষিণ ফ্রান্সের পিরেনিস পাহাড় শ্রেণীর ঠিক কোন পাহাড় থেকে গারন নদীর সঠিক উৎপত্তি – তা নিয়ে বহু গবেষণা বা মত বিরোধ থাকলেও তুলুস শহর কেন্দ্রের পাশ দিয়ে গারন বয়ে চলে ধীর শান্ত গতিতে। পিরেনিস পাহাড় থেকে শুরু হয়ে প্রায় দীর্ঘ ছয়শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে, এই নদী দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্স ও উত্তর স্পেনের অনেক শহর ও গ্রাম কে ছুঁয়েছে, অনেক ছোট ছোট নদী এসে গারনে মিলেছে, তারপর এই নদী অ্যাটল্যান্টিক সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে।
গারন নদীটি এমন ভাবে তুলুসের জীবন ধারণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, যে, মাঝে মাঝে ভুলেই যাই, এই শহর ছুঁয়ে এক নদী বয়ে চলেছে। একদিন জানলাম, সাইবেরিয়ার হাঁসেরা উষ্ণতার খোঁজে উড়ে যেতে যেতে, বিশ্রামের জন্যে গারন নদীর বুকে নেমেছে – এটা তুলুসের জীবনে এক নতুন ঘটনা। হয়তো বা আবহাওয়া বদলের জন্যেই হাঁসেদের তুলুস আগমন, দিক পরিবর্তন।
সেই সন্ধ্যায় গারনের তীরে সত্যিই হাঁসেদের চিৎকারে কান পাতা দায় ছিল, সেদিন, তুলুসবাসিরা অনেকেই তুলুসের সেই নতুন অতিথিদের স্বাগত জানাতে, গারনের তীরে পৌঁছে গিয়েছিল।
তারপর থেকে প্রতি বছরই দেখি, শীত শুরুর ঠিক আগে উত্তর থেকে প্রচুর হাঁসের দল উড়ে আসে, কিছুদিন গারনের বুকে দিন যাপন করে, বিশ্রাম নিয়ে, আবার একটু উষ্ণতার খোঁজে উড়ে যায় – এই ভাবেই গারন নদীকে ঘিরে তুলুস শহরের জীবন বয়ে চলে।
আর সেই নদী ও তার তীরের জীবনযাপন থেকে আমি এক মুঠো সময়ের স্মৃতিকে, একটি সন্ধ্যাকে, কিংবা হলুদ দুপুরকে, একটি রক্তিম সূর্যাস্তকে, বা শীতের কোন এক বিকেলের অদ্ভুত নরম সোনালি আলোকে নিজের মতো করে বন্দী করে নিতে চাই।