টুরিস্টদের কাছে তালিনের প্রধান আকর্ষণই হল – পুরনো তালিন শহরকেন্দ্র। আকাশচুম্বী আধুনিক অট্টালিকার সারি দিয়ে তৈরি আধুনিক, স্মার্ট তালিনের রূপ বোধহয় টুরিস্টকে আকর্ষণ করতে পারে না ।
পুরনো শহর, পুরনো স্থাপত্য, পুরনো গলি, পুরনো ছবি, ইতিহাস জড়ানো জীবন যাপন, ঐতিহ্য – ইউরোপের তো সেটাই বিশেষত্ব। তাই, তালিনের বিখ্যাত পুরনো অঞ্চলকে খুবই ভালো করে, সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। পুরনো তালিন শহরকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় – এক ভাগে পড়েছে পাহাড়ি এলাকা, আরেক ভাগে সমতল – আর পুরো শহরটিই পায়ে পায়ে আবিষ্কার করা যায়।
ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম, কাঁচা সোনা গলানো অপূর্ব রঙের রোদ ভাসিয়ে দিচ্ছিল পুরনো তালিনকে, ঐতিহাসিক শহর আমাদের সামনে নতুন রূপে ধরা দিচ্ছিল। ঘন নীল আকাশ – এখানে যেন আকাশ আরও বেশী ঘন নীল।
পুরনো শহর কেন্দ্রের পাশে হাঁটাপথেই ছিল আমাদের হোটেল। জুলাইয়ে এখানে খুব তাড়াতাড়ি সকাল হয় – ঝকঝকে সকাল, ইউরোপে এমনি ঝকঝকে সকাল যেন এক বিশাল উপহার। তাই মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে পথ চলা শুরু করেছিলাম।
পুরনো তালিনের যে অংশ পাহাড়ি, নাম তার – তম্পিয়া (Toompea), মিষ্টি নাম, যার মানে – ক্যাথিড্রাল পাহাড়। তালিনের সমস্ত ঐতিহ্যময় প্রাচীন ক্যাথিড্রাল ঐ তম্পিয়া পাহাড়েই দেখা যায়। পরিষ্কার নির্জন ঐতিহাসিক পথ ধরে চলতে চলতে দেখি আরও এক দু’জন সকালের তালিন দেখতে বেড়িয়ে পড়েছে।
সামারে সাধারণত ঐতিহাসিক তালিনের নাইট লাইফ খুবই দীর্ঘ হয় – কিন্তু, এতো সকালে রাস্তার কোথাও সেই রাত জাগার কোন চিহ্ন নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট – দেখেই মনে হয় ওরা ওদের নিজের জায়গাটাকে খুবই ভালোবাসে, যত্ন করে। ওদের নিজের গলি, নিজের পাড়া, নিজের দেশ পরিষ্কার রাখার জন্যে কোন ব্যক্তির ভাষণ শোণার প্রয়োজন হয় না। নিজের শহর পরিষ্কার রাখা ওদের জীবন যাপনের অঙ্গ, জানালায় একটু ফুল ফুটিয়ে পথের পাশে একটু রং ঢালা ওদের নেশা।
যাইহোক, পথের নানান ছবি দেখতে দেখতে তম্পিয়া পাহাড়ের সিঁড়ি ধরে উপরে পৌঁছে, তম্পিয়া পাহাড়ের নানান ক্যাথিড্রাল ও ক্যাথিড্রাল স্কোয়ারের সম্মুখীন হলাম – যথারীতি তম্পিয়া পাহাড়ও ইউনেস্কো হেরিটেজের অঙ্গ। ইস্তনিয়ানরা বিশ্বাস করে, এই পাহাড়ে দশম শতাব্দী থেকে মানুষের বসবাস।
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস বড়ই আশ্চর্য, আর সেই আশ্চর্য ইতিহাসকে, পুরনোকে নতুন করে বার বার আবিষ্কার করে যায় নতুন নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রজন্মের কাছে পুরনোকে জানা, চেনা তো শুধুই অর্থহীন তা নয়, পুরনোকে জানা মানে এক পদক্ষেপ, এক নতুন শুরু, পুরনো যেখান এসে থেমেছিল, নতুনেরা সেখান থেকে শুরু করতে পারে, পারে পুরনোকে সংরক্ষণ করতে, নবজীবন দিতে – তালিনের ঐতিহাসিক গলির মোড়ে নতুন দিনের শুরু দেখে তো তাই মনে হয়।