পৃথিবীর সবাই জানে ফরাসী ভাষা মানেই প্রেমের ভাষা, রোম্যান্টিক, শ্রুতিমধুর, মিষ্টি। জার্মান বা ইতালিয়ান ভাষার মতো রুক্ষ নয়, ফরাসীরা এক একটা শব্দকে বহু যত্নে উচ্চারণ করে, শব্দের শেষে ‘আর’ ‘এন’ ‘টি’ বা ‘এস’ থাকলে ভুলেও তা উচ্চারণ করে না, শব্দটিকে আলতো করে উচ্চারণ করে ছেড়ে দেয় – তাই অনেক সময়ই ফরাসী ভাষায় যা লেখা থাকে, উচ্চারণে সম্পূর্ণ বদলে যায়।
আর, সেই বদলে যাওয়া উচ্চারণ নিয়ে ওরা ছোট বেলা থেকেই এতো অভ্যস্ত হয়ে যায় যে, ইংরেজি ভাষা শিখলেও সেই উচ্চারনের প্রভাব রয়ে যায়, আর ইংরেজি মহলে ফরাসীদের উচ্চারণ নিয়ে প্রচুর রসিকতাও হয়, এমনকি সিনেমাতেও ফরাসীদের উচ্চারণ নিয়ে মজা করা হয়। যেমন, The Pink Panther সিরিজের ডিটেকটিভ Chief Inspector Jacques Clouseau র ফরাসী উচ্চারণের ইংরেজি শুনে অনেকেরই হাসি থামানো মুশকিল হয়।
তবে, ফরাসীরা নিজের ভাষার উচ্চারণের ব্যপারে খুবই সংবেদনশীল, ভুল উচ্চারণ করলে সঙ্গে সঙ্গে জিভ ঘুরিয়ে, গলা ফুলিয়ে উচ্চারণ ঠিক করে দেয় – বিদেশী কেউ একজন ওদের ভাষা ভুল ভাবে শিখে নিচ্ছে, তা যেন ওরা কেউই মেনে নিতে পারে না।
তাছাড়া, ফরাসীরা পৃথিবীর প্র্যত্যেকটি জিনিসকে দু’ভাগে ভাগ করেছে – পুঃ লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ। ‘লা’ ও ‘লে’ দিয়ে সেই লিঙ্গ বোঝানো হয়। কোন জিনিসের আগে ‘লা’ লাগবে না ‘লে’ লাগবে না ‘লু’ লাগবে, তা বাইরের মানুষ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। তুলুসে প্রথমে এসে গলির মোড়ে এক রেস্টুরেন্টের নাম ‘ লে গান্ধী’ দেখে হাসি থামতে বেশ কষ্ট হয়েছিল।
তাছাড়া, ফরাসী সংখ্যা তো আরও মজার। ছেলেবেলায় চা বাগানের এক কুলিকে তার বয়স জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে হাতে পায়ে গুণে উত্তর দিয়েছিল তিন কুড়ি পাঁচ – মানে পঁয়ষট্টি, এমনকি এখনো আসামে গ্রামের দিকে মানুষ সেই ভাবেই সংখ্যা হিসাব করে। ফরাসী ভাষার নাম্বার শিখতে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট খেয়েছিলাম – ফরাসী সংখ্যা গোণা ও আসামের চা বাগানের কুলিদের সংখ্যা গোণার মধ্যে মনে হল প্রচুর মিল আছে। অবশ্য, ষাট পর্যন্ত সংখ্যার নিজস্ব নাম আছে, কিন্তু ষাট পেরোলেই যোগ বা গুণ করে করে সংখ্যা বলতে হয়। যেমন, ফরাসী ভাষায় আশি মানে quatre (four) vingt (twenty) তথা চার কুড়ি। নব্বই মানে চার কুড়ি দশ (quatre vingts dix), ফ্রান্সে তাই বাজার করতে গেলে কথায় কথায় গুণ, ভাগ, যোগ, বিয়োগ করতে হয় – নিঃসন্দেহে, এই কারনেই ফরাসীরা অংকে বেশ ভালো।
যাইহোক, ফরাসী ভাষায় অনেক বাক্য আছে, যা কিনা সরাসরি অন্য ভাষায় অনুবাদ করলে কোন মানেই দাঁড়ায় না, এই বিদেশী ভাষার প্রচুর গলিখুঁজির ভিড়ে আমরা যেন হারিয়েই যাই। অবশ্য ভাষা শেখাটা এক সজীব পদ্ধতি, যতই তাঁর দৈনন্দিন ব্যবহার ততোই তার সৌন্দর্য, ততোই সেই ভাষা শেখা যায়, বোঝা যায়, ধারালো হয়ে ওঠে।