এপ্রিলের ইস্টারের ছুটিতে পিসা শহরে যেন টুরিস্ট উপছে পড়েছে। বাসে ট্রামে প্রচন্ড ভিড়, বাসের জানালার উপরে আবার বাংলায় লেখা পোস্টারও চোখে পড়ে – ইতালির এই শহরটার মধ্যে বেশ একটা অগোছালো ভাব, অনেকটাই যেন দেশের ছোঁয়া, খুব একটা ট্র্যাফিক নিয়ম নীতি মানার বালাই নেই – অত্যাধিক টুরিস্টের বোঝায় যা হয় আর কি?
যাইহোক, পিসার প্রধান টুরিস্ট আকর্ষণ Piazza dei Miracoli , বা meadow of miracles । মধ্যযুগের ইউরোপের সবচেয়ে আশ্চর্য অপূর্ব অট্টালিকার উপস্থিতি এই জায়গাকে বিখ্যাত করেছে তাই এখানেই টুরিস্টের ঢল নামে।
দেওয়াল ঘেরা এই জায়গার মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম সুক্ষ সুন্দর স্থাপত্যের অবস্থান তাই ইউনেস্কো এই জায়গাকে বহু আগেই হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে।
হোটেলের পাশ থেকেই বাস ধরে Piazza dei Miracoli পৌঁছতে হবে, বাসে দেখি তিল ধারনের জায়গা নেই, প্রচণ্ড ভিড়, কিন্তু, এই বাসই নিতে হবে। সাধারণত ইউরোপে বাসের পেছনের দরজা দিয়ে যাত্রীরা নামে ও সামনের দরজা দিয়ে ড্রাইভারের কাছে টিকিট কেটে বাসে চাপে।
সামনের দিকে পা রাখার জায়গা নেই, তাই অনেকেই দেখি পেছনের দরজা দিয়ে বাসে চেপে পড়েছে, অগত্যা আমরাও সেই বাসে চেপে পড়লাম। এবার কোন রকমে বাসের সামনের দিকে গিয়ে টিকিট কেটে আনতে হবে, না হলে আবার কড়া জরিমানা।
তাই, বাসে চেপেই সামনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম, কিন্তু, কিছুতেই যাওয়া যাচ্ছে না, এদিকে আবার ইতালির ভিড় বাসে চেপেই চোখে পড়ে গেল ‘পকেটমার হতে সাবধান’ বাণী, ব্যস শুরু হল পেছনের দিকে ঘন ঘন তাকিয়ে নিয়ে পিঠের ব্যাগ দেখা।
আর, আমাদের ঠিক পেছনেই ছিল এক দল আফ্রিকার লোক, আমাদের ঘন ঘন পেছন দিকে তাকানো বোধহয় ওদের অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল, ওদের মধ্যে একজন তো জিজ্ঞেসই করে ফেলল – কেন বার বার পেছনের দিকে দেখছ? আমরা কিন্তু পিক পকেটার নই। আমরা রীতিমত লজ্জায় পড়ে গিয়ে বললাম – না না, আমরা তো এমনিতেই পেছনের দিকে দেখছি। ভিড়ের মধ্যে এই ধরণের কথোপকথনের মধ্যে আমাদের আর সামনের দিকে গিয়ে বাসের টিকিট কাটা হল না, বাস পৌঁছে গেল Piazza dei Miracoli র সামনে, পেছনের দরজা খুলে গেল, পেছন থেকে নেমে পড়ার এক ধাক্কা এলো, নেমে পড়লাম, বাস চলে গেল নিজের পথে।
আমাদের আর টিকিট কাটা হল না। ইউরোপ ভ্রমণ কালে আমাদের সেই প্রথম ও শেষ বিনা টিকিটের বাস যাত্রা হল, বেশ এক উত্তেজনা বোধ করলাম, ইতালির বাসে বিনা টিকিটে যাত্রা করে কেন জানি না, বেশ এক অহেতুক রোমাঞ্চ বোধ হল।
যাইহোক, Piazza dei Miracoli গেট পেড়িয়ে ভেতরে গিয়ে মনে হল আমাদের জন্যে ওপাশে যেন এক বিরাট চমক অপেক্ষা করে ছিল, প্রথম দর্শনেই যেন বাগ্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ এক আশ্চর্য জায়গা, যে জায়গার স্থাপত্যের সুক্ষতায়, কারুকার্যে শতাব্দী কাল ধরে মানুষ মোহিত হয়েছে, নিজের চোখে না দেখলে এই জায়গার সৌন্দর্য যেন ঠিক বিশ্বাস হত না – মানুষের তৈরি এক অপরূপ বিশাল সৌন্দর্যে ডুবে আছে এই জায়গা।
সোনালি দুপুরের সোনালি আলো, শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত্য গুলোকে যেন বড় মমতা ভরে স্নান করিয়ে দিচ্ছে, ধুয়ে দিচ্ছে। মনে হল, পৃথিবী কতোই না সুন্দর, আরও যেন সুন্দর করে দিয়েছে মানুষ, এমনি সৌন্দর্য পৃথিবীর বুকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেঁচে থাকুক।