কিছু জীবন কথা – চার (One Summer Evening, Southern France)

বিদেশের এক নতুন জায়গায় বা শহরে বসবাস করা মানে তো শুধু সেই জায়গার স্থাপত্য, জ্ঞান বিজ্ঞান, ইতিহাস, কাজ, বা শহুরে জীবনই নয়, সেই জায়গার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন যাপন, চাওয়া পাওয়া, টানা পোড়েন, আশা নিরাশা, হাসি আনন্দ, জয় পরাজয়, আলাপ আলোচনা, খাওয়া দাওয়ার কিছুটা অংশীদার হওয়াও বটে। সম্পূর্ণ এক অন্য সংস্কৃতি, ফরাসী সংস্কৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখার এক সুযোগও বলা যায়। তাই, গরমের সময়ে তুলুস থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে একটু গ্রামের দিকে প্রোফেসর পিচফোর্ড ও প্রোফেসর বুফের  বাড়ীতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ সানন্দে গ্রহণ করি।

প্রোফেসর পিচফোর্ড ও প্রোফেসর বুফ দু’জনেই ফ্রান্সের প্লাজমা বিজ্ঞানের দুনিয়ায় দুই স্বনাম ধন্য ব্যক্তিত্ব, এবং দু’জনেই তুলুস ইউনিভার্সিটিতে উচ্চ পদে কর্মরত। প্লাজমা বিজ্ঞান দুনিয়ায় প্রচুর অবদানের জন্যে সবাই এই দম্পতীকে এক ডাকে চেনে। প্রোফেসর পিচফোর্ড আমেরিকান ও প্রোফেসর বুফ খাঁটি বনেদী ফরাসী। ইউনিভার্সিটি জীবনে দু’জনের দেখা হয়েছিল। বর্দুতে ওদের আদি বাস, আর ফ্রান্সে এটা ধরেই নেওয়া হয়, যে, বর্দুর আদি বাসিন্দারা সবাই খুবই ধনী।

যাইহোক, ওদের বাড়ীতে পৌঁছে মনে হল যেন এক স্বপ্নের জগতে চলে এসেছি।  সামনেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ – ফসল উঠে গেছে, মাঠের মাঝে মাঝে পড়ে আছে খড়ের স্তূপ – যেন Monet র ছবি। মাঠের ওপারে মিদিপিরিনিস পাহাড় শ্রেণীর হালকা নীলাভ রেখা, মাঝ দুপুরের হলুদ সোনালি আলো – এক্কেবারে দক্ষিণ ফ্রান্সের খাঁটি সামার পরিবেশ। দোতালায় প্রোফেসর বুফের কাজ ও পড়ার ঘর থেকেই এই দৃশ্য দেখা যায়। প্রোফেসর পিচফোর্ড হেসে জানালেন – তাইতো ও এই বাড়িটির এই ঘরটিই বেছেছে, এখানে বসে ও কাজ করতে ভালোবাসে, চিন্তা করতে পারে।

বিশাল উঠোনের দু’পাশে দু’টো বড় অলিভ গাছ, পাশে বড় সুইমিং পুল। দু’জনের গরম কাল নাকি সুইমিং পুলের পাশেই কেটে যায়। ওপাশে বিশাল ঢালু লনের ঘাস নিখুঁত ছাঁটা। বাড়ীর পেছনে বিশাল ফলের বাগানে – আপেল, ফিগ, প্লাম ফলে আছে। সেবার প্রোফেসর পিচফোর্ড ওর বাগানের প্লামের জেলি বানিয়ে আমাদেরও বড় এক বোতল জেলি দিয়েছিলেন – ঘরে তৈরি জেলির সে কি অপূর্ব স্বাদ।

এক নিশ্চিন্ত ইউরোপিয়ান জীবন যাপন আর কি, অথচ নিখাদ, সহজ, সরল, সাবলীল ওদের ব্যবহার, কোথাও অর্থের অহেতুক প্রকাশ নেই, অর্থের দম্ভ নেই, নেই অহং – এটাই বহু সাধারণ ফরাসী জীবন যাপনের ছবি। শহর যতই বাড়ে শান্তি প্রিয় আসল ফরাসীরা আরও আরও গ্রামের দিকে চলে যায় – জীবনকে অনেক বেশী ছড়িয়ে, মেলে দিয়ে, প্রকৃতির কাছাকাছি বাঁচতে চায় এরা। এই গ্রামে নাকি মাত্র চল্লিশ ঘরের বসবাস।

নিমন্ত্রিতদের মধ্যে অনেকেই যদিও আন্তর্জাতিক, তবে ফ্রান্সের প্লাজমা বিজ্ঞান জগতে সবারই যথেষ্ট অবদান আছে। যেমন – ডক্টর হেগ্লার নেদারল্যান্ডের মানুষ, জীবনে কখনোই হুইল চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারে নি – কিন্তু, ওনার সতেজ উর্বর মস্তিষ্ক প্লাজমা বিজ্ঞানের রহস্য সমাধানে সদা সক্রিয়, আবার তিনি খুব ভালো পিয়ানোও বাজান। শারীরিক ভাবে অসহায় মানুষটির মনের অসম্ভব শক্তি দেখে আশ্চর্য হতে হয়।

তাছাড়া, আমার মনে হয় মানসিক দিক দিয়ে ইউরোপিয়ানরা অনেক বেশী গোছানো, শক্ত, দৃঢ়। জীবনে কখন কি করতে হয় তা যেন খুব ভালো ভাবে জানে – বিশেষ করে ফরাসীরা তো খুবই গোছানো।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে, দূরের দৃশ্য অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায় আর ফরাসী গ্রামের নির্মল আকাশে ফুটে ওঠে লক্ষ তারা। সুইমিং পুল নীলাভ মায়াবী আলোয় জ্বলে ওঠে, পুলের ধারে বসে নানা কথায়, নানা বিজ্ঞান আলোচনায় রাত গভীর হতে থাকে। আর, ইউরোপ প্রবাসে নানা নামী মানুষের সংস্পর্শে এসে, দ্রুত চলমান জীবনের মুহূর্তকে ধরে রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াসে, তাঁদের জীবন যাপনের নানা টুকরো ছবি দিয়ে ভরে ওঠে আমাদের জীবন স্মৃতির পাতা।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Memory-Lane, Western-Europe and tagged , , , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s