তুলুসের অক্টোবর মেলা (Toulouse, France)

তুলুসে অক্টোবরের শুরুতেই আলতো পায়ে শীত নামতে শুরু করে দেয়, দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হতে থাকে। আর, সেই বৃদ্ধ জড় শীত জাঁকিয়ে নামার আগেই তুলুসবাসীরা যেন সেরে নিতে চায় বছরের শেষ আনন্দযজ্ঞ গুলো। তুলুস বসবাসের প্রথম দিন গুলো আমাদের কাছে ছিল এক নতুন জায়গাকে আবিষ্কারের দিন, কৌতূহলের দিন, আর এক আশ্চর্যের দিন। নতুন জায়গা, নতুন ভাষা, নতুন মানুষ, নতুন শহরের রাস্তাঘাট, প্রতিটি জিনিসই নতুন, প্রতিটি মোড় নতুন – তাই প্রতিটি দিনই আমাদের কাছে কিছু না কিছু শেখার দিন ছিল।

তাই, তুলুসে এসে একদম শহর কেন্দ্রেই থাকার জায়গা খুঁজে নিয়েছিলাম – ঝন্‌ ঝরাসের ব্যস্ত রাস্তার পাশেই ছিল আমাদের মধ্যযুগীয় ফ্ল্যাট। অন্তত বাইরে থেকে তো তাই দেখায়, কিন্তু ভেতরের সবই আধুনিক। শহর কেন্দ্রে লাল ইটের তৈরি সমস্ত বিল্ডিং-ই রেনেসাঁর সময়ের – তাই এই গোলাপি শহরের ঐতিহাসিক ছবি বজায় রাখার জন্যে বাইরে থেকে বিল্ডিং সংস্কার করা যায় না, করতে হলে আগের মতো করেই করতে হয়। ঝন্‌ ঝরাসের সেই ফ্ল্যাট থেকে একটু হেঁটে পাশেই ক্যাপিটল, আর এক দিকে ফ্রঁসে ভারদের বিশাল বাগান – Le Grand Rond, ও jardin des plantes। তাই প্রায় দিনই সন্ধ্যায় বাগানের দিকে হাঁটা আমাদের তুলুস বসবাসের এক আনুষঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়।

যাইহোক, অক্টোবরের শুরুতে এক ছুটির দিনের সন্ধ্যের মুখে দেখি Le Grand Rond বাগানের দিক থেকে সারি সারি লোক, সঙ্গে বাচ্চা নিয়ে হেঁটে ফিরছে – কাঁধে কারুর বড় পুতুল, ছোট পুতুল। কৌতূহলী হয়ে জানলাম – পার্কে অক্টোবরের মেলা বসেছে। স্বভাবতই ফ্রান্সে মেলার ধরণ কেমন হয় জানার জন্যে ঢুকে পড়লাম পার্কে। মেলা বলতে আমরা যা জানি হরেক রকম জিনিস কেনা বেচার মেলা – তা কিন্তু এক্কেবারেই নয়। নানা বয়সের জন্যে শুধু নানা রকমের খেলা, লাকি ড্র, বন্দুক দিয়ে ছোট ছোট পুতুল বা খেলনা লক্ষ্য করে মারা – আর লক্ষ্যে মারতে পারলে পুতুলটি বা খেলনাটি যে খেলছে তার, ঘোস্ট টানেল, নানা রকম রাইড, ঘোড়ায় চড়া ইত্যাদি দিয়েই সাজানো এই ছোট্ট ঘরোয়া মেলা। অবশ্যই প্রচুর খাবার দোকান। মোট কথা নানা বয়সের নানা নির্ভেজাল আনন্দের আয়োজন এখানে। নতুন জায়গার নতুন ধরণের মেলা, নতুন অভিজ্ঞতা – ভালোই। শুধু একটা পুতুল জেতার আশায় অহেতুক বন্দুক চালাতে হল – একটা গুলিও লক্ষ্য ভেদ করতে পারলো না।

তারপর, তো কতো বছর কেটে গেছে, তুলুসে দিনে দিনে প্রচুর মানুষ বেড়েছে। স্থানীয় পরিসংখ্যান বলছে, উন্নতিশীল এই শহরে প্রতিবছর প্রায় আঠারো হাজার নতুন মানুষ বসবাস করতে আসছে। যা কিনা এক ইউরোপিয়ান শহরের কাছে খুবই বেশী। তাই ঘরোয়া সেই মেলার আয়তনও অনেক বেড়ে গেছে আর পুরনো জায়গায় ঠিক করে মেলা আয়োজন করা যাচ্ছে না। অগত্যা অক্টোবর মেলার জায়গা পরিবর্তন হয়ে গেলো – এখন শহরের একটু বাইরে Zenith এর বিশাল চত্বরে এই মেলার আসর বসে। এখন আর আমার দেখা সেই ছোট্ট ঘরোয়া ফরাসী মেলার চেহারা একদম বদলে গেছে, চাকচিক্য, আলোর রোশনাই, মানুষ সবই বেড়েছে, সে রীতিমত পরিণত, বিস্তৃত, বিশাল, ভয় হয় ভিড়ে বুঝি বা হারিয়ে যাবো।

সবই বেড়ে ওঠে, বদলে যায়, পরিণতি পায়। জীবন বাড়ে, মানুষ বাড়ে, বাড়ে শহর, গ্রাম – পরিণতির দিকে যাত্রা করে পৃথিবীর সবই, এই তো নিয়তি, পৃথিবীর এক নিয়ম। কিন্তু, যখনই তুলুসের অক্টোবর মেলার কথা হয়, আমার চোখে কিন্তু ভেসে ওঠে সেই শান্ত, ছোট্ট, ঘরোয়া মেলার ছবি, সন্ধ্যার মুখে স্বল্প আলোয় পুতুল কাঁধে হেঁটে চলা এক দল হাসি খুশী মানুষের ছবি।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel, Western-Europe and tagged , , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s