ভেনিসের দৈনন্দিন জনস্রোতের ছন্দে গা ভাসাতে হলে অতি অবশ্যই বিখ্যাত Piazza San Marco বা শুধুই সান মার্কও স্কোয়ারে পা রাখতেই হয়। ভেনিসের হৃদয় ও আত্মা বলা যেতে পারে এই স্কোয়ারকে কিংবা নেপোলিয়ানের ভাষায় “the drawing room of Europe” ও বলা যায়। হাজার পায়রা ও ইউরোপের নানা দেশের মানুষের ভিড়ে এই স্কোয়ার সর্বদাই প্রাণচঞ্চল, উৎসবমুখর।
স্কোয়ারের চারদিকে নজর কাড়া স্থাপত্যে চোখ রেখে, নানা রঙের মানুষের ভিড়ে চোখ রেখে, পায়রাদের সামনে দানা ছড়িয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার ভেনিস বিকেল কেমন করে যে কেটে যায় বুঝতেই পারি না। ভেনিস শহরের ভেতরে চলতে ফিরতে জলের এক হালকা শ্যাওলা শ্যাওলা গন্ধ কিন্তু পিছু ছাড়ে না। মাঝে মাঝেই জলের বুক ছুঁয়ে দমকা হাওয়া শ্যাওলা গন্ধ বয়ে আনে।
যাইহোক, এই স্কোয়ারে ঢোকার মুখেই যে অলঙ্কৃত স্থাপত্যের দিকে উপস্থিত হাজার টুরিস্টের নজর পড়বেই তা হল – St Mark’s Basilica ও পাশে লাল ইট রঙের উঁচু চারকোণা এক বেল টাওয়ার ‘St Mark’s Campanile ’। এই উঁচু বেল টাওয়ারই এই স্কোয়ারের অতি চেনা এক প্রতীক। অতীতে ভেনিস বন্দরে এই উঁচু টাওয়ার লাইট হাউস হিসাবে কাজ করতো। প্রায় একশো মিটারের কাছাকাছি উচ্চতার এই টাওয়ার বেশ কয়েকবারই ধ্বংস হয়েছিল, কিন্তু ভেনিস অহং ও স্কোয়ারের প্রতীক এই টাওয়ারকে বার বার নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে বা মেরামত করা হয়েছে। ভেতরে লিফট নিয়ে যায় বেল টাওয়ারের চূড়ায়।
Italo-Byzantine স্থাপত্যের নিদর্শন এবং ভেনেশিয়ান সম্পদ ও শক্তির প্রতীক St Mark চার্চে অবশ্য এখন সংস্কার চলছে, তাই চার্চের কিছু অংশ ঢেকে রাখা, তবুও যে টুকু অংশ দেখা যায় তারই সৌন্দর্যে মানুষ বিমোহিত হয়। বিকেলের দিকে দেখি দলে দলে প্রচুর জাপানি টুরিস্ট হানা দিয়েছে এখানে। চার্চের সোনালি মোজেইক ও অপূর্ব সোনালি কারুকার্যের জন্যে এই চার্চের আরেক ডাক নাম আছে – ‘Church of gold’।
এই স্কোয়ারের আরেক ল্যান্ডমার্ক ভেনেসিয়ান গথিক স্থাপত্য – Doge’s Palace। অতীতের ভেনেসিয়ান রিপাবলিকের প্রধান ডিউকের বাসস্থান এই প্রাসাদ এখন ভেনিসের অন্যতম মিউজিয়াম। কারুকার্য খচিত এই প্রাসাদ ও থাম দেওয়া দরদালান ভেনিসের শৌর্য, শক্তি, ও সম্পদ দেখানোর জন্যেই তৈরি হয়েছিল। ভেনেসিয়ান এই স্কোয়ারে এসে এই প্রাসাদ দেখে টুরিস্টরা যেন স্বীকার করে নেয় একসময় ইউরোপের মধ্যে ভেনিসই শক্তি ও সম্পদে প্রথম ছিল।
তাছাড়া, স্কোয়ারের চারিদিকে সারি বাঁধা অন্যান্য স্থাপত্য ‘Procuratie Vecchie’ অতীতের ভেনেসিয়ান রিপাবলিকের চিহ্ন বহন করে। সেই সময়ের সরকারী ও ধর্মীয় ম্যানেজারদের অফিস ছিল এই বিল্ডিঙগুলো। বর্তমানেও ভেনিসের সরকারী কেন্দ্র এই স্থাপত্য। Procuratie Vecchie র নীচে সারি সারি রেস্টুরেন্ট ও ফ্যাশন বুটিকের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইতালিয়ান জীবনের ছবি দেখি। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে হাওয়ায় এখনো ঠাণ্ডার স্পর্শ, কিন্তু এই স্কোয়ারে উপস্থিত জনতার ভিড়ে, চলাফেরায় উষ্ণতার ছোঁয়া, আনন্দের কোলাহল। সব কিছু পেছনে রেখে হেঁটে চলি, ‘চরৈবেতি’ মন্ত্রকে স্মরণ করে।