তুষার ঢাকা সাদা আল্পস পাহাড় শ্রেণী, আল্পসের বরফ টানেল, পাহাড়ের গায়ে চঞ্চল চপল তন্বি ঝর্ণা, ঢালু উঁচু নিচু হলুদ ঘাস ফুলে ঢাকা মাঠ, ঐতিহাসিক দুর্গ, চার্চ, পাহাড়ি ঝিল, সুন্দর সুইস গ্রাম, শহর সবই এক সঙ্গে দেখে নিতে হলে, অতি অবশ্যই সুইজারল্যান্ডের ল্যান্ডস্কেপ ট্রেন গুলোর যে কোন একটাতে চেপে বসতে হয়।
ল্যান্ডস্কেপ ট্রেন গুলো নিয়ে যায় আল্পসের চূড়ায়, দুর্গম তুষার ঢাকা পাহাড়ি অঞ্চলের রেল পথে চলে সুইস রেল। সুইস ইঞ্জিনিয়ারিং এর এক আশ্চর্য নিদর্শন এই রেলপথ, তাই সুইজারল্যান্ডে এসে ল্যান্ডস্কেপ ট্রেন গুলোর যে কোন একটায় যাত্রা করা সুইস ভ্রমণের অন্তর্গত। কোথাও ট্রেন থেকে নামার প্রয়োজন নেই, সারাদিন ট্রেনে বসে শুধুই সুইস সৌন্দর্য উপভোগ করাই নিয়ম এখানে। অবশ্য এই ট্রেন গুলো খুব কম স্টেশনেই দাঁড়ায়। পাহাড়ি দুর্গম পথে কখনো ধীরে আবার কখনো দ্রুত গতিতে বেশ এক ছন্দে ছন্দে চলে ট্রেন গুলো। যেহেতু এই ট্রেনের উদ্দেশ্যই হল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা, তাই জানালা থেকে ছাদ পর্যন্ত সমস্তই কাঁচ দিয়ে মোড়া। সে এক অভিনব রেল যাত্রা।
আমরা বেছে নিয়েছিলাম পৃথিবী বিখ্যাত সুইস ট্রেন ‘গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস’। তুষার স্বর্গ Zermatt থেকে St. Moritz পর্যন্ত এই রেলপথের যাত্রা। এই ট্রেনে সবাই জানালার ধারটিই পায়। প্রত্যেকটি বসার জায়গার সঙ্গের কাঁচের জানালা গুলোকে এতো পরিষ্কার ও স্বচ্ছ বোধহয় সুইসরাই রাখতে জানে। বিদেশীরা বেড়াতে এসে ওদের দেশের সৌন্দর্য যাতে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে তাঁর সমস্ত ব্যবস্থা করে সুইসরা। ট্রেনটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
ফেব্রুয়ারির শীতের সকালের প্রথম রোদ এসে যখন ট্রেনের কাঁচের জানালা ও ছাদ দিয়ে ভেতরে এসে লুটিয়ে পড়ল এক অদ্ভুত ভালো লাগা ছুঁয়ে গেল মনে। সোনালি রোদের দিনে সুইস সৌন্দর্য নিজেকে যেন আরও মেলে ধরে। ট্রেন চলা শুরু হলে কিছুক্ষণ পরে সুইস সুন্দরী এসে জিজ্ঞেস করল – চা, কফি, ব্রেকফাস্ট কি চাই? ব্রেকফাস্ট তো হোটেলেই সেরে এসেছিলাম, তাই ‘ক্যাফে ও লে’ কফিরই অর্ডার দিলাম। কে জানত গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেসে কফির দাম সাধারণ কফির চেয়ে অন্তত চার গুণ দামের হবে।
কত নদী, গ্রাম, পথ, তুষার ঢাকা পাহাড় সরে সরে যায় দু’পাশে। শুধু দেখি আর দেখি, সোনালি রোদে পাহাড়ি পথের নীচে, দূরে ছবির মতো সুইস গ্রামের রোদ্র স্নান দেখতে দেখতে ট্রেনটি আরও আরও উপরের দিকে চলে। এই রেল পথের যাত্রায় ইউরোপ তথা সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিখ্যাত দুই নদী Rhone ও Rhine উপত্যকার অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায়, দেখা যায় এই উপত্যকা অঞ্চলের তুষারাবৃত সুইস জীবন ছবি।
বুক ভরে দম নিয়ে উঁচু পাহাড়ি রেলপথে ট্রেনটি যখন Gotthard Pass পেরিয়ে যায়, পেরিয়ে যায় Albula ভ্যালি, পার হয় ব্রিজ, বরফ টানেলে ঢুকে যায়, সরু পাথুরে পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যায়, তুষারমরু পেরিয়ে যায়, চোখের সামনে সরে সরে যায় দিগন্ত বিস্তৃত জনহীন সাদা আলপাইন তুষার প্রান্তর, নাম না জানা কোন এক সুইস গ্রামের তুষার ঢাকা চার্চ, আল্পসের তুষারাবৃত সাদা পাহাড় শ্রেণী – চলন্ত ট্রেনের উষ্ণতায়, ভেতরে বসে দেখতে দেখতে আশ্চর্য অনুভূতি হয়, রোমাঞ্চ হয়, ভালো লাগে।
মনে হয়, জীবনের আরেক নাম বোধহয় গতি, জীবন ও তো এই ট্রেনটির মতোই কখনো জিরিয়ে, দম নিয়ে জীবন পথের নানা দৃশ্যের সাক্ষী হতে হতে চলেছে দুর্গম পথে, এক অজানা ষ্টেশনের উদ্দ্যেশ্যে।