পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে (Lisbon, Portugal)

July 2011, Lisbon, Portugal

মসলার রাস্তা ধরে ভারতবর্ষের অবস্থানকে জেনেছিল পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো দা গামা, আজও ভারতবর্ষের সেই মসলার প্রেমে ডুবে আছে পর্তুগীজরা। আজও পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে অতীতের সেই মসলার বাজারে মসলার গন্ধ ম ম করে, আজও চড়া দামে মশলা কেনা বেচা হয়। আজও পর্তুগালের রান্নায় গরম মশলা না হলে পর্তুগীজদের মুখে রোচে না, এমনকি কফির উপরেও দারুচিনির গুড়ো ছড়িয়ে দেয় পর্তুগীজরা।

পর্তুগালের অর্থনীতিতে ভাস্কো দা গামার আবিস্কৃত ভারতবর্ষের মসলার অবদান কিন্তু পর্তুগীজরা আজও ভোলে নি। ভাস্কো দা গামার নামে ব্রিজ, রেল ষ্টেশন, টাওয়ার, মেমোরিয়াল আরও কত কি। ইউরোপে কোন দেশে একা কোন মানুষের নামে এতো কিছু কখনই দেখি নি। আজকের লিসবনে এসে মনে হয় শুধু ‘ভাস্কো দা গামা’ বলে ছেড়ে দিলে কিন্তু লিসবনের মানুষেরই ধাঁধা লাগবে – মানুষ না ব্রিজ না রেলস্টেশন কিসের কথা বলছে রে বাবা।

পর্তুগালের ইতিহাসে ভাস্কো দা গামার সমসাময়িক সময় ছিল আবিষ্কারের সময়, জলদস্যুর সময় – সেই সময়কে মনে রেখে Tagus  নদীর তীরে যেখান থেকে সমুদ্রের উদ্দ্যেশ্যে, ভারতবর্ষের দিকে জাহাজ ছাড়ত সেখানে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে  Padrão dos Descobrimentos বা Monument to the Discoveries। কিছু দূর হেঁটে গেলেই দেখা যায় অপূর্ব Santa Maria de Belém বা শুধুই Belém টাওয়ার।

এখানে এসে  Tagus  নদীর বিস্তৃত তীরে UNESCO র সংরক্ষিত আরেক স্থাপত্য – Jerónimos Monastery দেখে যে কোন মানুষই মুগ্ধ হতে বাধ্য। খুব বেশী ঐতিহাসিক সত্যের সুক্ষ বিচারে না গিয়েও Jerónimos Monastery র গায়ে গায়ে পাথুরে ভাস্কর্যের সূক্ষ্মতায়, সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে, অবাক হয়ে দেখতেই হয় টুরিস্টদের।

লিসবন শহরের নিজস্ব দুই রূপ আছে, এক অতি পুরাতন ঐতিহাসিক রূপ যার গায়ে গায়ে ইতিহাসের রহস্যময় আবছায়া, পাথরে বাঁধানো সরু অলি গলিতে অতীতের সোঁদা গন্ধ, অতি পুরনো এক জীবনযাত্রা যেখানে মুচিরা আজও পুরনো জুতো সেলাই করছে, জানালার বাইরে দড়ি ঝুলিয়ে কাপড় শুকোচ্ছে – ইউরোপের অন্য শহরে যে দৃশ্য বিরল। আরেক অত্যাধুনিক রূপ, যার চাকচিক্যে নজর ফেরানোই দায়। লিসবনের এই দুই রূপ ও ছন্দকে জানতে হলে এই শহরের ভিড়ের এক জন হয়ে জানাই সবচেয়ে ভালো। কিংবা, লিসবনের ঐতিহাসিক ট্রামে চেপে এই শহরের জীবন ধারনের ধারাটিকে বোঝার চেষ্টা করতে কোন বাধা নেই।

লিসবনে পথ চলতে চলতে হাঁটার রাস্তায় সাদা কালো পাথরের নানান নক্সা অনায়াসে নজর কাড়ে, অদ্ভুত অদ্ভুত নক্সা টুরিস্ট পথিকের পথ চলা থামিয়ে দেয়, ক্যামেরায় চোখ রাখায়। পর্তুগালের পথের এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট ইউরোপের অন্য কোথাও দেখি নি। অতি সযত্নে সাদা পাথরের মাঝে মাঝে কালো পাথর বসিয়ে রীতিমত শিল্পীর মত এই সব নক্সা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

জুলাইয়ের এই সময়ে লিসবনের রাস্তার ধারে সারি বাধা বড় বড় জাকারান্ডা ফুলের গাছে অদ্ভুত সুন্দর ফুল ফুটতে শুরু করেছে। পর্তুগীজ নাবিকরা দেশ বিদেশ থেকে নানান প্রজাতির গাছ গাছড়াও নিয়ে এসেছিল নিজের দেশে। আমাদের দেশের অতি সাধারণ ফুল – জবা, পুটুস, নয়নতারা ও দেখি লিসবনের রাস্তার ধারের বাগান আলো করেছে। হয়তো বা শত বছর আগে নাবিকদের সঙ্গে ঐ ফুলেরা ভারতবর্ষ থেকে পাড়ি দিয়েছিল সাগর পথে পর্তুগালের দিকে।

লিসবনের ঐতিহাসিক অংশের চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে এক ঐতিহাসিক লিফট চোখে পড়বেই। নাম তাঁর Santa Justa Lift। বহু পুরনো, কাঠের তৈরি এই লিফট চেপে উপর থেকে লিসবনের প্যানরামিক দৃশ্য দেখা যায়, তাই টিকিট কেটে লিফটে চড়ে বসলাম, ধীরে ধীরে লিসবন শহরের উপরে সন্ধ্যা নামছে, বাতাস একটু একটু করে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, একে একে রাস্তার ও দোকানের আলো জ্বলে উঠছে। সন্ধ্যার এই সন্ধিক্ষণে এক তিরতিরে ভালো লাগা আক্রান্ত করছে। মানুষের সঙ্গে যেন কোন কোন জায়গার এক অদৃশ্য বন্ধন সৃষ্টি হয়ে যায় আর সেই বন্ধনে বাধা পড়ে মানুষের নিয়তি। শারীরিক ভাবে না থেকেও মানসিক উপস্থিতি রয়ে যায় সেই জায়গার বাতাসে। বাতাস সেই বার্তা বয় – সেই মানুষটি এসেছিল এখানে, এখানেই দাঁড়িয়ে দেখেছিল পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নামা।

        

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, Portugal, Travel and tagged , , , , , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

4 Responses to পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে (Lisbon, Portugal)

  1. তথাগত's avatar trdastidar বলেছেন:

    খুব ঘুরছেন দেখছি! বর্ণনা পড়ে ভাল লাগল। ভাস্কোডা গামার যে এখনো এত প্রতিপত্তি জানা ছিলনা। ছবি গুলো এজ অলওয়েজ ভাল।

  2. তথাগত's avatar trdastidar বলেছেন:

    অনেকদিন লিখছেননা, কী ব্যাপার? 🙂

abakprithibi এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল