না, এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি ইংরেজি সিনেমার কোন দৃশ্য নয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের প্রাক্বালে হিটলারের তৈরি সত্যিকারের এক concentration camp। ১৯৩৩ সালে তৈরি প্রথম এই concentration camp প্রথমদিকে শুধুই রাজনৈতিক বন্দি, জার্মান কম্যুনিস্ট, ক্রিমিনালদের রাখার জন্যেই ছিল।
Munich থেকে কিছু দূরে বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত জায়গা জার্মানির এই ডাহাও গ্রাম। এখন অবশ্য বোঝার উপায় নেই শান্ত নির্জন, উদাস এই জায়গাতেই এক সময়ে ইউরোপিয়ান ইহুদিদের উপরে নরকের অত্যাচার চলেছিল, চলেছিল মৃত্যু মিছিল। এখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, ইউরোপের ইতিহাসের এক আতঙ্কময়, বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল এখানেই।
পরে যুদ্ধের দাবানলের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপিয়ানদের কাছে এই জায়গাই ছিল ন্যাৎসি বা গেস্টাপো আতঙ্কের আরেক নাম, সেই সময়ের সবচেয়ে বড় concentration camp এখানেই তৈরি হয়েছিল। এখানে ss গার্ডদের কিভাবে অন্যান্য ক্যাম্পের বন্দীদের উপরে অত্যাচার করতে হয় তারই ট্রেনিং দেওয়া হত। নানান রকম অত্যাচারের মডেল হিসাবে কাজ করেছিল এই ক্যাম্প।
প্রাচীর ঘেরা বিশাল এই ক্যাম্পে ঢোকার মুখেই লোহার গেটে লোহার অক্ষরে কুখ্যাত জার্মান শ্লোগান Arbeit macht frei, মানে Work makes you free। হিটলারের সমস্ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ঢোকার মুখেই এই শ্লোগান লেখা ছিল। হয়তো কথাটার গভীর কোন এক দার্শনিক দৃষ্টি ভঙ্গি ছিল, কিন্তু এতো স্থূল অর্থে এই কথাটা ব্যবহার করেছিল ন্যাৎসি বাহিনী যে পৃথিবীর কাছে জার্মান এই প্রবাদটি কুখ্যাত হয়ে গেছে।
এখানের বন্দীদের দিয়ে অমানুষিক ভাবে প্রচুর কাজ করানো হত – বিশেষ করে ফ্যাক্টরির কাজ, রাস্তার মাটি কাটার কাজ ইত্যাদি, অসুস্থ দুর্বল বন্দীদের মেরে ফেলারই আদেশ ছিল। প্রথম দিকে যদিও বা কোন কোন বন্দী ভালো কাজ করার জন্যে মুক্ত হয়েছিল কিন্তু পরের দিকে এখানের বন্দীদের মৃত্যু ছাড়া অন্য মুক্তি ছিল না। এমনকি বন্দীদের উপরে নানা রকমের মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্টও করা হত। অমানবিক অত্যাচারের অন্তর্গত মেডিক্যাল পরীক্ষায় হাজার বন্দীদের উপরে নাৎসি ডাক্তার ম্যালেরিয়া রোগের ঔষধ আবিষ্কারের আশায় ম্যালেরিয়ার জীবাণু ইঞ্জেক্ট করে দিয়েছিল।
সাধারণ লোহার তার দিয়ে ঘেরা বিশাল এক জায়গায় সারি সারি ঘরেই বন্দীদের থাকার ব্যবস্থা। সেই সময় এই সমস্ত সাধারণ তারের বেড়ায় ছিল high voltage electric current । এক দু’জন বন্দী যদিও বা পালাতে চেষ্টা করতো বিদ্যুতাহত হয়ে মারাই যেত। জার্মানির সমস্ত আবহাওয়াতেই খালি পায়ে সামনের বিশাল চত্বরে বন্দীদের রোল কলের জন্যে উপস্থিত হতে হত। এই ক্যাম্প প্রথমদিকে শুধুই বন্দীশালা ছিল তাই এখানে গণহত্যার জন্যে হিটলারের কুখ্যাত গ্যাস চেম্বার অনেক পরে তৈরি হয়েছিল।
১৯৪৫ এ আমেরিকান সৈন্য যখন Third reich এর জীবনকালের সমবয়সী এই ক্যাম্প গেস্টাপোদের কবল থেকে মুক্ত করে, ২৭০০০ বন্দী তখনও মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছিল। ন্যাৎসি আতঙ্কের অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই এই ক্যাম্প আবার আমেরিকান সেনার অস্থায়ী ব্যারাক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে আবার ss অফিসারদের এখানেই বন্দী করা হয়।
এখনও এই ক্যাম্প আমেরিকার দখলে। জার্মানির মধ্যে, কিন্তু, আমেরিকাই এই ক্যাম্পের দেখাশোনা করে। আমেরিকা ইউরোপিয়ান ইতিহাসের কালিমাকে যেন পৃথিবীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায়। তাই এককালের আতঙ্কপীঠ এখন এক মনখারাপ করা ধূসর, বিষণ্ণ ভ্রমণ কেন্দ্র। অনামি হাজার জার্মান ইহুদি ও রাশিয়ান বন্দীদের শহিদভূমি, মেমোরিয়াল।