December 2011, Kodaikanal, India
প্রতি বারো বছর অন্তর এক অদ্ভুত নীল ফুল ‘কুরুঞ্জি ফুল’ ফোটে এই পাহাড়ের জঙ্গলে, পালনি পাহাড়শ্রেণীকে নীল কার্পেটের মতো ঢেকে দেয় এই অদ্ভুত নীল ফুল। তার মাতোয়ারা বুনো গন্ধে ঘোর লাগে এই অঞ্চলের মানুষের। পালনি পাহাড়শ্রেণীর কোলে এই অদ্ভুত ফুলকে ঘিরে বহু গল্প ফেরে মানুষের মুখে। দাক্ষিণাত্যের সেই পাহাড়শ্রেণীর কোলে এক শীতল শৈল শহর কোদাইকানাল এবার আমাদের গন্ত্যব্য।
দক্ষিণ ভারত যখন গরমে ত্রাহি ত্রাহি করে সেখানে কোদাইকানাল যেন এক ওয়েসিস, প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি এক শীতল জায়গা। গরম জায়গার নিয়মটিকে অমান্য করে আশ্চর্য এই ঠাণ্ডা জায়গা স্বভাবতই এখানের সবাইকে আকর্ষণ করে।
সেবার ডিসেম্বর মাসে মাদুরাইয়ে রীতিমত গরম, ফ্যান ছাড়া থাকাই যাচ্ছে না। তাই যখন কোদাইকানাল বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব হল, সবাই এক কথায় রাজি। মাদুরাইয়ে সারা বছরে কখনোই ঠাণ্ডা পড়ে না, সারা বছর গরম। তাই কোদাইকানাল যাওয়ার কথায় বাক্সে তুলে রাখা সমস্ত উলের জামা কাপড় বেরিয়ে পড়ল – টুপি, গ্লাভস, মাফলার, সোয়েটার, গরম চাদর, কোট কি নেই! মনে হল যেন উত্তর মেরু বেড়াতে যাচ্ছি। গরম কাপড় গোছানর বহর দেখে জিজ্ঞেস করলাম – কত ঠাণ্ডা পড়বে ওখানে।?
ভালোই ঠাণ্ডা পড়ে – উত্তর এল। মাদুরাইয়ে বহুদিন ধরে আছে দাদা। এদিকের সমস্ত ব্যাপার জানে।
কত টেম্পারেচার হবে? – গাণিতিক প্রশ্ন আমার।
তা ঐ দশ বারো হবে – বিজ্ঞের মত জবাব এল দাদার কাছ থেকে।
হুম, বুঝলাম মাদুরাইয়ে থেকে থেকে গরমে অভ্যস্ত দাদাদের পরিবারের কাছে কোদাইকানালের ঠাণ্ডা অনেকটা উত্তরমেরুর ঠাণ্ডাই বটে। শীতের এই সমস্ত আনুষঙ্গিক গুলোর তাই খুবই দরকার। ঠাণ্ডা পড়া সাউথের মানুষের কাছে এক বিলাসিতা।
যাইহোক, সমস্ত গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়া গেল। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি, অল্প কুয়াশা মাঝে মাঝে আছন্ন করে ফেলছে পথ। যতই উপরের দিকে যাচ্ছি ধীরে ধীরে বেশ এক শীত শীত অনুভূতি হচ্ছে আর একে একে ঠাণ্ডার জামা কাপড়, শাল, সোয়েটার সবই বেড়িয়ে পড়ছে ব্যাগ থেকে।
সজল প্রকৃতির সৌন্দর্যে প্রান ভরে যায়, দুচোখ ভরে দেখি। সত্যি বিধাতার কি অপূর্ব সৃষ্টি। দুদিন থাকবো এই শৈল শহরে। ভারতবর্ষের গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্যে ব্রিটিশরা নানা শৈল শহরকে নিজেদের উপযুক্ত বাসস্থান তৈরি করে নিয়েছিল- তাঁর ছাপ এই কোদাইকানালেও স্পষ্ট। কিন্তু, শৈল শহরের সেই নির্জনতা আর নেই। প্র্যতেকেই ভিড় করেছে শীতকালের একটু শীতের খোঁজে, একটু ঠাণ্ডার আশায়। তবে এক উৎসবের অদ্ভুত আমেজ এই শহরের ভিড়ে।
দল বেঁধে বিকেলের দিকে কোদাই লেকের পাশে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। কোদাই লেকের পাশে প্রচুর দোকান পসরা সাজিয়েছে – কোদাই চা, ঘরে তৈরি চকোলেট, শাল, সোয়েটার, টুপি, স্যুভেনির, কাঠের তৈরি হাতের কাজ সব নিয়ে এক জমজমাট ব্যাপার।
লেকের পাশে জঙ্গল এলাকা ধরে হেঁটে ঘুরে দেখা যায় আবার লেকের জলে প্যাডেল বোট ট্রিপ ও করা যায়। এক শান্ত পরিবেশ। কোদাই লেকে প্যাডেল বোট চালিয়ে বহু দূর চলে যাই। পড়ন্ত বেলার মিষ্টি রোদের নরম উত্তাপ অদ্ভুত এক ভালো লাগা বোধ সৃষ্টি করে।
পরে যখন এই লেখা লিখছি কোদাই লেকের ব্যাপারে কিছু বিষয় জেনে মন বিষণ্ণ হয়ে গেল। ভাবি প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টিকে দূষিত করার অধিকার মানুষ কোথা থেকে পেল? এই কোদাই লেকের জল নাকি mercury emissions দ্বারা দূষিত। পাশের হিন্দুস্থান লিভারের থার্মোমিটার ফ্যাক্টরির অনিয়ন্ত্রিত আবর্জনা এই কোদাইকানাল এলাকাকে দূষিত করেছে। এই পারদ দূষণ সমস্ত প্রাণী জাতি ও মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করে। সময়মত দূষণ প্রতিরোধ না করলে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষও বিপন্ন হবে। তবে মানুষ যেমন দূষণ তৈরি করেছে তেমনি কিছু আশাবাদী মানুষই দূষণ প্রতিরোধে তৎপর হয়েছে। সেই আশাবাদী মানুষের দলে নাম লিখিয়ে সবুজ, নির্মল, দূষণ মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি।
Onek din pore ajke abar porlam, as usual khub i sundor… Haimanti di ki Mysore er lekhata Poreche? Na porle obbosoi pathas…
Thank you….