তুলুস এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের গাড়ি যখন তুলুসের শহর কেন্দ্রে ঢুকল, শহরের সবুজ দেখে প্রান ভরে গেল। এক শহরে এতো সবুজ পার্ক থাকতে পারে? ধুলি ধূসরিত দূষিত ধোঁয়াশার শহর থেকে এসে একটু অবাক হয়েই দেখছিলাম এই শহরের সবুজ শ্যামলিমা। বিশাল এক গোল পার্ক ঘিরে আমাদের গাড়ি তুলুসের অস্থায়ী বাসস্থানের দিকে চলে গেল। পরে জেনেছিলাম সেই পার্কের নাম Le Grand Rond, বিশাল বিশাল গাছ, ফুলের বিছানা দিয়ে সাজানো সেই পার্কের পাশেই এক ফ্রেঞ্চ ভদ্রমহিলা – মিসেস ফণীয়ের বাড়ীতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে – ইউনিভার্সিটি থেকেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
মিসেস ফণীয়ের ষাটের কোঠায় বয়স, তিনি এক কালে এয়ার হোস্টেস ছিলেন। নানা দেশে ঘুরে ঘুরে বর্তমানে থিতু হয়েছেন তুলুসে, একাই থাকেন। চমৎকার ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে ইংলিশ বলতে পারেন। আট তলায় সুন্দর সাজানো গোছানো ফ্রেঞ্চ এপার্টমেন্ট, প্রচুর বই দেওয়াল জুড়ে অথচ সবই ফ্রেঞ্চে। বলে দিলেন ওনার রান্নাঘর যত ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারি – দেখিয়ে দিলেন তিনি কোথায় কি রাখেন। যত ইচ্ছা বই পড়তে পারি, যত ইচ্ছা টি ভি দেখতে পারি, তুলুসের যেখানে খুশি বেড়াতে যেতে পারি। তবে রান্না ও বেড়াতে যাওয়া ছাড়া আর অন্যান্য সবই ফ্রেঞ্চে তাই ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই।
ওনার বসার ঘরের বেলকনি থেকে তুলুস শহরের জনজীবন চোখে পড়ে, যত দূর চোখ যায় লাল ইটের এই Ville Rose এর ব্যস্ততা দেখে সময় কেটে যায় অনায়াসে। মে মাসের মাঝামাঝি এই সময়ে খুবই বৃষ্টি ও ঠাণ্ডা পড়েছে তুলুসে। বিকেলে হঠাৎ আকাশ কালো করে মেঘ হয়ে শিলা বৃষ্টিতে সারা তুলুস সাদা হয়ে গেল। মিসেস ফণীয়ের আবার বেলকনিতে প্রচুর মরশুমি ফুল লাগিয়েছিলেন – সমস্তই নষ্ট হয়ে যায় সেই শিলা বৃষ্টিতে। মিসেস ফণীয়ের সে কি দুঃখ – আ ম বেল ফ্লুর।
মিসেস ফণীয়ের সকালে আমাদের জন্যে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতেন, কখনো বা আমিই তৈরি করে নিতাম। প্রথম দিনই তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন – তোমরা কি ইংলিশ ব্রেকফাস্ট না ফ্রেঞ্চ ব্রেকফাস্ট করবে?
ফ্রান্সে এসে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট! নৈব নৈব চ। তাই হেসে বললাম – ফ্রেঞ্চ।
খুব খুশি হয়ে তিনি বললেন – ফ্রেঞ্চ ব্রেকফাস্ট ইজ বেস্ট।
প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে বাজার যেতেন পরের দিনের ব্রেকফাস্টের জিনিস কিনতে। সেই প্রথম ফ্রেঞ্চ ব্রেড ‘বাগেত’ এর সঙ্গে পরিচয় আমাদের। প্রথম দিকে শক্ত কুড়কুড়ে সেই ব্রেডে কামড় দিয়ে মুখের নুন ছাল চিরে গিয়েছিল। তারপর তো ধীরে ধীরে ফ্রেঞ্চ বাগেতের প্রেমে পড়েছি।
ডিম পোঁচ তৈরি করতেন নিখুঁত ভাবে, বলতেন – ফ্রেঞ্চ মেয়েদের তখনি বিয়ের উপযুক্ত বলা হয় যখন সে ডিম পোঁচ ভালো করে তৈরি করে।
সকাল হত কফির গন্ধে। বড় গোল বাটিতে Café au lait, ফ্রেঞ্চ বাগেত সঙ্গে ঘরে তৈরি স্ত্রবেরি জেলি ফ্রেঞ্চে বলে Confiture, ডিম পোঁচ, ফল দিয়ে ফ্রেঞ্চ ব্রেকফাস্ট সারা হত।
সকালের সেই কফি ও ডিম ভাজার গন্ধ যেন আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেছে, সেই গন্ধ আমাকে আজও ফ্রান্সের প্রথম দিনগুলোর কথা মনে করায়। সেই গন্ধে মিসেস ফণীয়ের গোছানো রান্না ঘরে ভেজা ভেজা শীত শীত ফ্রেঞ্চ সকালের কথা মনে হয়।
মিসেস ফণীয়ের সপ্তাহে দু’দিন কাজে যেতেন, ওনার বন্ধুর এক বুটিকে বসতেন। কাজে বেরনোর দিনে ওনার সে কি আনন্দ। সকাল থেকেই নানান মেক আপ দিয়ে সুন্দর করে সেজে নিতেন, চুলেও রঙ করে ছিমছাম হয়ে বেরোতেন কাজে। ফিরে এসে ওয়াইন গ্লাস নিয়ে বসতেন টি ভি র সামনে। আর সমানে কাজের গল্প করতেন। অন্যান্য দিনে বিশাল এই এপার্টমেন্ট পরিষ্কার করা, গাছ লাগানো, পরিচর্যা করা সবই করতেন নিজ হাতে।
প্রায় দিনই বিকেলের দিকে বলতেন – চল বেড়াতে যাই। ওনার সঙ্গেই তুলুসের সঙ্গে প্রথম জানা, প্রথম চেনা। এস্কুইরল তুলুসের কেন্দ্র, প্রায়ই মিসেস ফণীয়ের সঙ্গে ঘুরতে যেতাম । ধীরে ধীরে শহরটিকে চিনে গেলাম, জেনে গেলাম কোথায় কি পাওয়া যায়। তারপর তো গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে তুলুসকে কতই না বদলাতে দেখেছি, বাড়তে দেখেছি।
আমি আপনার ভ্রমণ-ব্লগের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত! আর্কাইভ ঘেঁটে একদম শুরু থেকে পড়ছি, অসাধারন! চালু থাকুক আপনার পথ চলা, হাজার বছর ধরে
অনেক ধন্যবাদ। আমার ভ্রমণ লেখা আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইল।