হাজার ঝর্ণার দেশে (Plitvice Lakes National Park, Croatia)

September 2013, Plitvice, Croatia 

এখানে ‘সারা দিনমান বাজে ঝরনার গান’, এখানে আজ ক্রোয়েশিয়ার পাহাড়ে, জঙ্গলে ‘পথ ভুলিবার খেলা’ ‘মন হারাবার বেলা’।

এখানে নিরন্তর পায়ের নীচ দিয়ে ঝর্না বয়ে যায়। এখানে গাঢ় ফিরোজা রঙের লেকে উঁচু পাহাড় থেকে ঝর্ণা লুটিয়ে পড়ে। এখানে পাহাড়ের খাদে হাজার ঝর্ণা প্রতি নিয়ত নতুন পথ খুঁজে বয়ে চলে। ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি ফিরোজা রঙের স্বচ্ছ জলে নির্ভয়ে মাছেরা ঘোরাফেরা করে। গভীর শান্তি এই পাহাড়ি জল-জঙ্গলের দেশে।

সভ্যতার উজ্জ্বল আলো থেকে বহুদূরে এই লেক আজ ইউনেস্কোর প্রাকৃতিক হেরিটেজ। স্প্লিট থেকে বাস ধরে রাত প্রায় আটটায় পৌঁছে গিয়েছিলাম Plitvice Lakes National Park এর গ্রামে।

আমাদের বাস ড্রাইভার বেশ ভালো, আমাদের হোটেলের ঠিকানা বলতেই আমাদের বলে দিল কি করে যেতে হবে। যদিও ইন্টারনেট দেখে জঙ্গলের রাস্তায় হোটেলের রাস্তা জেনে এসেছিলাম, তবুও এই ঘন জঙ্গলের দেশে বাস ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে আস্বস্ত হলাম।

 অন্ধকার বাস স্টপে জনমানব নেই, শুধু আমরা দু’জনই নামলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। হাইওয়ে দিয়ে প্রায় তিনশো মিটার হেঁটেই আমাদের হোটেল, আসলে হোটেল নয়, এই গ্রামের স্থানীয় মানুষের বাড়ী।

এই প্রথম ইউরোপে টর্চের ব্যাবহার করলাম। ঘন অন্ধকারের বুক চিরে মাঝে মাঝেই এক দুটো গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। টর্চের আলোর বৃত্ত দেখে দেখে হেঁটে চললাম।

কিছু দূর হাঁটার পরেই চোখে পড়ল, চারিদিকের ঘন অন্ধকার, জঙ্গল, পাহাড়ের মাঝে মাঠের মধ্যে ছবির মতো একটি বাড়ি আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে। একাকী এই সুন্দর বাড়ীতে যাওয়ার আঁকাবাঁকা রাস্তা অন্ধকারের সঙ্গে মানানসই স্তিমিত আলো দিয়ে সাজানো। এই আলো যেন অন্ধকারকে সম্মান জানাবার জন্যেই স্তিমিত। এই সময়ে এখানে বেশ ঠাণ্ডাই পড়েছে। দু’জনে হেঁটে বাড়ীতে যাওয়ার সময়ে পাশে কুকুরের এক ছোট্ট ঘর থেকে ছোট্ট কুকুরের পাহারার মৃদু ঘেউ শুনলাম, গৃহকর্তা যেন আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীর উঠোনের কড়া  আলো জ্বলে উঠল। গৃহকর্তা বেড়িয়ে এসে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। কাঠের বাড়ীর উপরের তলার ঘরে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা।

কাঠের ঘর, জানালার ওপাশে নিকষ কালো অন্ধকার, আকাশ ভরা তারা, ঝি ঝি পোকার ডাক – এখানে এক অদ্ভুত আদিম, বন্য অনুভূতি দেয়।

এই ন্যাশনাল পার্ক দেখতে এখানে বছরে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আসে। ক্রয়েশিয়ান সরকার চাইলেই এখানে প্রচুর বড় হোটেল ইত্যাদি তৈরির পারমিশন দিয়ে জায়গাটাকে জমজমাট করে তুলতেই পারতো, কিন্তু না, এই পাহাড় জল-জঙ্গলের নির্জন আদিমতা বজায় রাখার জন্যেই যেন স্থানীয় মানুষের সুন্দর ছবির মত বাড়ীতে থাকার এই ব্যবস্থা।

পরেরদিন খুব সকালেই বেড়িয়ে পড়লাম। বাড়ী-হোটেল থেকে বেড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যের সরু রাস্তা ধরে হেঁটে বিশাল এই লেক এলাকায় ঢোকা যায়। এই বিশাল Cascade  লেক ভালো করে দেখতে হলে প্রায় ছয় থেকে আট ঘণ্টা পাহাড়ি পথে হাঁটতে হয়। প্রায় তিনশো বর্গ কিলোমিটার পাহাড়, জঙ্গল এলাকা ঘিরে এই ন্যাশনাল পার্ক। এই Cascade  লেক আর ঝর্ণার দেশে প্রাকৃতিক ভাবে প্রায় ষোলটা নানান মাপের লেক তৈরি হয়েছে এবং প্রতিটি লেক ঝর্ণা দিয়ে যুক্ত।

এনট্রান্স এক এ (E1) টিকিট কেটে ঢুকেই দেখি সবুজ, নীল আর ফিরোজা রঙের খেলা। এতো বড় এই লেক অঞ্চলে আবার বাসও চলে। যাদের হাঁটতে অসুবিধা তারা বাসে করে একদম উপরে upper lake এ পৌঁছে যায়, তারপর জঙ্গলে মধ্যে লেকের পাশে রাস্তা ধরে দেখতে দেখতে নামে ও পরে ইলেকট্রিক বোটে, বড় lower lake পার হয়ে নিচের লেকের ঝর্ণা দেখতে দেখতে ফেরে।

লেক অঞ্চলে দু’বার বাস চড়া ও একবার নৌকো চড়া এই টিকিটের অন্তর্গত। কিন্তু, আমাদের হোটেল থেকে বলে দিয়েছিল যদি নিচের লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় তাহলে নীচ থেকে দেখতে দেখতে হেঁটে উপরে পৌঁছে, বাস নিয়ে ষ্টেশন এক এ এসে দেখতে দেখতে ফিরলে সবচেয়ে ভালো। আমরা স্থানীয় মানুষের উপদেশ মাথায় রেখে হেঁটে নিচের ফিরোজা রঙের লেক দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। অতি অবশ্যই, ঝর্ণার সৌন্দর্য নীচ থেকেই ভালো বোঝা যায়।

পথে পড়ে বিশাল লেক, বোটে পার হয়ে আবার শুরু হল হাঁটা। লেকের জল এতোই স্বচ্ছ যে মাছেদের চলাফেরার প্রতিটি মুহূর্ত দেখা যাচ্ছে। লেকের উপরে, ঝর্ণার উপরে কাঠ দিয়ে বাঁধানো রাস্তা ধরে অনায়াসেই ছোট ছোট ঝর্ণা, লেক পার হয়ে যাচ্ছি। ঝর্ণার উপরে হেঁটে যাওয়ার এক অদ্ভুত অনুভূতি। ঝর্ণার শব্দে এই জায়গা মুখর।

লেকের ধারে মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ধাপে ধাপে Cascade  লেক গুলো পেরিয়ে upper lake এ পৌঁছে যাই। এখানে প্রতিটি মুহূর্তে অপূর্ব দৃশ্য আমাদের পথ সঙ্গী, চোখ জুড়িয়ে যায়, প্রান ভরে যায়।

জঙ্গলের পথে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছিল খেয়ালই ছিল না। এখানে প্রকৃতি কতো সুন্দর, এবং সেই সৌন্দর্যকে বজায় রাখার যে প্রচেষ্টা তাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম না। এতো বড় জঙ্গল এলাকায়, প্রতিদিন এতো মানুষ ঘুরতে যায়, প্র্যতেকেই খাবার খায় এই অঞ্চলে কিন্তু এক টুকরো প্ল্যাস্টিক কোথাও পড়ে নেই- এতোই পরিচ্ছন্ন।

এখানে চলতে চলতে প্রতিটি বাঁকে অপূর্ব দৃশ্যে থমকে যেতেই হয়। দেখে দেখে চোখ যদিও মুগ্ধ, মন যেন ভরে না। শেষ বিকেলের আলো পড়ে নীল আকাশের নীচে সবুজ-নীল জল যেন আরও সুন্দর হয়েছে, লেকের জঙ্গল অঞ্চলের ভেতর থেকে দূরে দেখা যাচ্ছে আমাদের বাড়ী- হোটেল।

বিকেলে ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী Zagreb যাওয়ার বাস ধরতে হবে। জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট বাস স্টপ থেকে বাসে চেপে বসলাম। পেছনে পড়ে রইল সবুজ-ফিরোজা এক নির্জন অপূর্ব পৃথিবী। সবুজের খোঁজে, নির্জনতার খোঁজে, শান্তির খোঁজে বারবার মানুষ ফিরবে সেখানে।    

সারাদিন ঝর্ণার গান শুনে বিভোর আমরা। স্মৃতি মন্থন করতে গিয়ে এখনো যেন শুনতে পাই সেই সুর, দেখি সেই ছবি।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Croatia, Europe, Travel and tagged , , , , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s