September 2013, Zagreb, Croatia
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নবীনতম সদস্য দেশ ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী শহরে সন্ধ্যার মুখে পা রেখেই মনে হল এই শহর যেন রক্ষণশীল মানুষের শহর। শনিবারের সন্ধ্যায় রাস্তায় বা রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টে লোকজন বা টুরিস্ট খুব একটা চোখে পড়ছে না। সাধারণত শনিবারের সন্ধ্যায় ইউরোপের অন্য শহরে প্রচুর মানুষ বাইরে থাকে, রেস্টুরেন্টে খায়, কিন্তু রাত ন’টায় মানুষ জন নজরে না পড়ায় বেশ আশ্চর্য হলাম।
হোটেলে পৌঁছে একঘণ্টার মধ্যে তরতাজা হয়েই ইচ্ছে হল রাতের এই শহরকে ঘুরে দেখার। রিসেপশনে ম্যাপ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম রাতের এই শহরকে কোথায় ভালো অনুভব করা যাবে। বলে দিল, কিছুক্ষণ সোজা পথে হেঁটে গেলেই শহরের মধ্যে যাওয়া যাবে। নতুন শহরকে দেখার নেশায় বেড়িয়ে তো পড়লাম, কিন্তু রাস্তা নির্জন, টুরিস্ট তো নেইই। স্থানীয় মানুষও একজন বা দু’জন। খালি রেস্টুরেন্টে খেয়ে এই শহরের রাতের রক্ষণশীলতা দেখে হোটেলে ফিরে এলাম।
পরেরদিন বেশ সকালেই বেড়িয়ে পড়লাম। সকালে কিন্তু বহু টুরিস্ট ঘুরছে, স্থানীয় মানুষ রবিবারের দৈনন্দিন কাজে বাজার হাটে বেড়িয়ে পড়েছে। শহরটি যথারীতি নিজের ছন্দে জেগে উঠেছে।
Zagreb শহরটি পাহাড়ের উপরে ও নীচে – দুই অংশেই ছড়িয়ে আছে। নিচের অংশে এই শহরের প্রধান চত্বর Ban Jelačić Square, ১৯ শতকের এই স্কয়ারের চারপাশে নানান ধরণের ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যায়। এই স্কয়ারের একদম মাঝে আছে Ban Josip Jelačić এর ভাস্কর্য। বহু আগের স্থাপিত এই মনুমেন্ট কম্যুনিস্ট শাসনের সময়ে সরানো হয়েছিল কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতার পরে আবার যথাস্থানে বর্তমান।
এই মূর্তির একটু দূরেই আছে ১৯ শতকের Mandusevac Fountain । কথিত আছে, অতীতে যুদ্ধ ফেরত এক ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত যোদ্ধা Manda নামে এক সুন্দরী মেয়েকে এই ফোয়ারা থেকে ক্রয়েশিয়ার ভাষায় একটু জল তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। ক্রোয়েশিয়ার ভাষায় সেই অনুরোধটি ছিল ‘zagrabiti’ সেই থেকে এই শহরের নাম হয় জাগ্রেব ও ফোয়ারাটি মেয়েটির নামে পরিচিত হয়।
এই স্কয়ারের পাশে যে রাস্তা উপরের দিকে উঠে গেছে, সেই রাস্তা ধরে হেঁটে পৌঁছে যাই ক্যাথিড্রাল স্কোয়ারে। ক্যাথিড্রালের উঁচু দুই চূড়া যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। বলা বাহুল্য, এই ক্যাথিড্রালের উঁচু চূড়া জাগ্রেব শহরের আকাশ রেখা। যদিও নিও-গথিক স্টাইলের এই ক্যাথিড্রাল ১৯ শতকের তৈরি কিন্তু এই ক্যাথিড্রালের সূচনা বহু আগের।
রবিবারের সকালে স্থানীয় প্রায় সকলেই চার্চে আসে, প্রার্থনা করে। ক্যাথিড্রালের সামনে প্রচুর টুরিস্ট। বহু স্থানীয় মহিলা ও পুরুষ চার্চের সামনে স্থানীয় সুন্দর সাদা পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি বেঁধে, হাতে ঝুড়ি ভর্তি ফল ও কেক, মাথায় লাল কাপড়ের ঢাকা, মুখে হাসি।
ওদের মুখের আপ্যায়নের হাসি যেন জাগ্রেবে আগের রাতের সমস্ত রক্ষণশীলতার চাদর সরিয়ে দিল। অনেক টুরিস্ট ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ফটো তুলতে ব্যস্ত। সবারই যেন রবিবারের সকাল সার্থক হল। ওরা ওদের হাতের ঝুড়ি থেকে প্র্যতেকের হাতে কেকের টুকরো ও ফল বের করে হাতে তুলে দিচ্ছে।
এতক্ষণে বোঝা গেল ওদের হাতের ঝুড়ির রহস্য। আমাদের দু’জনের দিকেও হাসিমুখে কেক ও ফল দিতে এগিয়ে এলো। উপস্থিত সবাইকে বিনামূল্যে ফল ও কেক বিতরণ করে ওরা হাসতে হাসতে ক্যাথিড্রালের দিকে চলে গেল। বিদেশী টুরিস্টদের প্রতি এতো আপ্যায়ন ! দেখে ভালো লাগলো। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ ।