7th July 2013, Riga, Latvia
বিদেশিদের কাছে লাটভিয়ার এই নাচ ও গানের উৎসব আশ্চর্য লাগতে পারে। কিন্তু, এই উৎসবে জড়িয়ে আছে লাটভিয়ার স্বাধীনতার গল্প। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর দেশ জুড়ে এই নাচ গানের উৎসব লাটভিয়ান মানুষের হৃদয় জুড়ে থাকে।
সৌভাগ্যবশত আমারা ঠিক সেই সময়েই লাটভিয়ার রাজধানী রিগায় ছিলাম। কোন এক ভিন দেশের জাতীয় উৎসব সেই দেশকে আরও বেশী মেলে ধরে। উৎসবের সময়ে এক নজরেই সেই দেশের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ছবি ফুটে ওঠে। আমারাও লাটভিয়ার নাচ গানের উৎসবের ছন্দে তালে তালে পা ফেললাম।
মেয়েদের মাথায় ফুলের মুকুট, হাতে ফুলের তোড়া, মুখে আনন্দের হাসি, পরনে জাতীয় পোশাক। প্রচুর নর নারী লাটভিয়ান ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরে এই দিনে রাস্তায় নেমেছে। উজ্জ্বল দিনে এই রংবেরঙের পোশাকে পুরো রিগা আলোকিত হয়ে উঠেছে।
সারা রাস্তা জুড়ে গান গেয়ে, নাচ সহযোগে মিছিল চলছে। দর্শকরাও সেই সুরে সুর মেলাচ্ছে। প্রত্যেকের মুখে হাসি। স্বাধীনতার স্বাদ সব দেশেই সমান, সব দেশেই উৎসবে মানুষের মুখে নির্ভেজাল হাসি ফোটে। এই দিনে মানুষ প্রতিদিনের টানাপড়েন ভুলে গিয়ে উৎসবের আনন্দে গা ভাসায়, প্রাণখোলা হাসে।
উৎসবের অঙ্গ হিসাবে পার্কে লাটভিয়ান আর্ট ও ক্র্যাফটের মেলা বসেছে। পুরনো দিনের লাটভিয়ান খাবার- ল্যাম্ব স্যুপ, রোস্ট ল্যাম্ব, রোস্টেড আলু, সবজি; ঝুড়ি, এম্বার পাথরের গয়না, আলু ভাজা, লাটভিয়ান ড্রেস ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। সম্পূর্ণ মেলাতে ছড়িয়ে আছে লাটভিয়ান ঐতিহ্য।
দীর্ঘ দিনের বিদেশি শাসন, ১৯ শতকের রাজনৈতিক ও সামাজিক পালাবদলে জর্জরিত ছিল লাটভিয়া। সেই সময়ে লাটভিয়ান মানুষ জেগে উঠেছিল, অনেক দিনের বিদেশি শক্তির তলে হারিয়ে যাচ্ছিল ওদের নিজেদের পরিচয়, নিজেদের অস্ত্বিত্ব। শুধু গানই ছিল ওদের নিজস্ব সংস্কৃতির অঙ্গ। সব কেড়েছিল বিদেশি শাসন কিন্তু লাটভিয়ান মানুষের গলার গান, গলার সুর কেড়ে নিতে পারেনি। সেই গান গেয়েই ওরা ফিরে পেয়েছিল নিজেদের স্বাধীনতা।
লাটভিয়ান লোকগীতি বা dainas সবার মুখে। যদিও রাশিয়ান শাসনের সময়ে সমস্ত ব্যাপারে রাশিয়ান প্রভাব পড়েছে, গানেও পড়েছে কিন্তু লাটভিয়ান মানুষের প্রতিবাদের ভাষা ছিল গান ও লোকগীতির সুর। ওরা বুঝেছিল নিজেদের জাতীয় পরিচয় একমাত্র গান, তাই এই উৎসব ওদের জাতীয় অস্তিত্বের প্রতীক।
আশির দশকে এই গানই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লাটভিয়ান প্রতিবাদ, লাটভিয়ানদের প্রধান অস্ত্র। শুধু লাটভিয়া নয়, সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে ইস্টোনিয়া ও লিথুয়ানিয়াও আশির দশকে গান গেয়ে প্রতিবাদ জানায়, স্বাধীনতার আবেদন করে।
এই গানের আন্দোলনে (Singing Revolution) আশির দশকে বাল্টিক সমুদ্র তীরের এই তিন দেশের প্রায় দুই লক্ষ মানুষ Baltic Way ধরে হাতে হাত ধরে গান গেয়ে প্রতিবাদ জানায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। তালিনিনের Toompea পাহাড়ের নীচ থেকে শুরু করে ভিলিনিয়াসের Gediminas Tower এর পাদদেশ পর্যন্ত প্রায় ছ’শো কিলোমিটার মানব শৃঙ্খল তৈরি হয়। এই দীর্ঘ পথে রিগা এবং দুগাভা নদীও পার হয় সেই মানব শৃঙ্খল।
জুলাইয়ের এই সময়ে বালটিক্সের প্রায় সব জায়গাতেই গানের ও নাচের উৎসব হয়। এই গান ও নাচের উৎসবের উদ্দ্যেশ্য যে শুধু নিখাদ আনন্দ তা নয়, এই উৎসব নিজেদের অস্ত্বিত্ব, নিজেদের পরিচয় বাঁচিয়ে রাখার এক সযত্ন প্রয়াস, লাটভিয়ান সংস্কৃতির প্রতীক, গানের সুরে স্বাধীনতা প্রাপ্তির অমরগাথা। পুরো দেশের মানুষ যখন এক সুরে একই গান গায় UNESCO বলতে বাধ্য ‘Masterpieces of the Oral and Intangible Heritage of Humanity’।