লিথুনিয়ার রাজধানী শহর ভিলিনুসের কেন্দ্র থেকে যে সবুজ এক পাহাড় দেখা যায়, তা আসলে এক পার্ক – নাম তার Kalnai Park । যার আক্ষরিক মানে হল Park of Hills – চারটে পাহাড় নিয়ে সবুজ দিয়ে ঘেরা বিশাল এই পাহাড় পার্ক।
প্রায় চব্বিশ হেক্টর জমির উপরে তৈরি এই পাহাড় পার্কের এক দিকে আছে Neris নদী ও আরেক দিকে আছে ভিলিনুসের নদী Vilnia । ঐ চারটে পাহাড়ের মধ্যে সাধারণত Crooked Hill সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয়। প্রথমত Crooked Hill এর একদম চূড়ায় পৌঁছে ভিলিনুস শহরের অপূর্ব মনমুগ্ধকর বিস্তারিত দৃশ্যের চমক দেখা যায়।
আর দ্বিতীয়ত ঐ উচ্চতায় তিনটে বিশাল আকারের আকাশ চুম্বী ক্রস দেখা যায় – যা কিনা এক গুরুত্বপূর্ণ টুরিস্ট গন্ত্যব্য। তাই স্থানীয়রা অনেকেই Crooked Hill কে থ্রি ক্রস হিল বলে। স্থানীয় লোককথায় শোণা যায় – এই জায়গায় তিনজন ক্রিশ্চান মঙ্ককে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করে নদিতে তাদের দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর তাদের স্মরণে কাঠের তিনটে ক্রস এই জায়গায় স্থাপন করা হয়েছিল। পরে, ১৯১৬ তে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই টিন ক্রস।
কিন্তু, পঞ্চাশের দশকে সোভিয়েত শাসন কালে এই তিনটে ক্রস ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। পরে লিথুনিয়া সোভিয়েত শাসন মুক্ত হওয়ার পরেই পুনরায় সেই তিনটে ক্রস এই জায়গায় স্থাপিত করা হয়েছিল। বর্তমানে এই পাহাড় পার্ক শুধু যে টুরিস্ট গন্ত্যব্য তা নয় – এক ধর্মীয় স্থানও বটে। রবিবারে ছুটির দিনে অনেকেই তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ঐ তিন ক্রসের নিচে যায় – মোম জ্বেলে দেয়, প্রার্থনা করে।
ভিলিনুস শহর কেন্দ্র থেকে এক রাস্তা সোজা উপরের দিকে চলে গেছে – সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলে ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা ধরে একদম উপরে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু, শুনেছিলাম, অনেকেই জঙ্গুলে খাড়া পথে শর্টকাট ধরে উপরে পৌঁছতে ভালোবাসে- সেই পথে সময় অনেক কম লাগে।
একটু এগিয়েই দেখি ঘন সবুজ জঙ্গলে ঢাকা এক সরু পায়ে চলা পথ একদম খাড়া উপরের দিকে চলে গেছে – স্পষ্ট পথও ঠিক নয়। মনে হল মানুষ চলাচল করে পথ তৈরি করেছে, জঙ্গল যে কোন সময় সেই পথ ঢেকে দেবে।
অচেনা এক দেশে, অচেনা জায়গায় ঘন জঙ্গলের সেই পথ-বিহীন পথ ধরব কিনা সে নিয়ে প্রথমে একটু দ্বিধা যদিও ছিল, কিন্তু, অ্যাডভেঞ্চারের এক চোরা নেশা সেই জঙ্গুলে পথ ধরার জন্যে হাতছানি দিচ্ছিল।
প্রায়, আধ ঘণ্টা ধরে, সবুজ ঘন জঙ্গলের পাহাড়ী পথ ধরে, চলতে চলতে যখন সন্দেহ জাগছিল – ঠিক এলাম তো। ঠিক তখুনি, সামনেই দেখি – তিনটে সাদা ক্রস, আকাশ ছুঁয়ে ফেলার নেশায় মগ্ন। তারপর, একটু এগিয়েই দেখি – ভিলিনুস শহরকে সোনালি রোদের আভা বড় মমতায় স্পর্শ করছে। এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে।
প্রতিটি জায়গার গায়ে এক গল্প জড়িয়ে থাকে – সময়ের গল্প, মানুষের গল্প, বদলে যাওয়ার গল্প, ইতিহাস – কত গল্প নিয়েই না পৃথিবীর এক একটি জায়গা মত্ত থাকে।
একদিন এই পৃথিবীতে আমরা থাকবো না – ঐ জায়গা আমাদের উপস্থিতির মুহূর্ত গুলো ধরে রাখবে – অদৃশ্য ভাবে।
আমরা এখানে এসেছিলাম, এই জায়গার সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে দূরের শহর রেখায় চোখ রেখেছিলাম। জীবন দেখেছিলাম।
সোনালি রোদের আলো আমাদের সহ ঐ শহরটিকেও এক মায়াবী স্বপ্ন আলোয় রাঙ্গিয়ে দিয়েছিল – সেটাই তো আমাদের গল্প। এই জায়গার অনন্ত কালের এক মুহূর্তে আমাদের উপস্থিতির গল্প। আমরা থেকে যাবো সেই গল্পে – গল্পের চরিত্র হয়।
না, হয়তো, কেউই এই জায়গায় আমাদের উপস্থিতির গল্প কাউকে বলবে না – নাই বা বলুক। আমরা এসেছিলাম, দেখেছিলাম, আশ্চর্য হয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম, সেই গল্পটি আমরাই না হয় বলে যাবো। আর এই জায়গাটি আমাদের উপস্থিতির গল্পটি বুকে গেঁথে নিয়ে থেকে যাবে – যতদিন পৃথিবী আছে। এটাই তো মহৎ পাওয়া। জীবনের কাছে এর চেয়ে বেশী আর কি চাওয়ার আছে?