মালাগা সমুদ্র তীরে পৌঁছনো মাত্রই গন্ধটি নাকে এসেছিল। সমুদ্রের নোনা হাওয়া সেই গন্ধ বয়ে আনছিল – কাঠ পোড়ানো ধোঁয়া ও মাছ রোষ্টের সম্মিলিত এক গন্ধ – মাতাল করা সেই গন্ধ – মানুষের আদিম প্রবৃত্তি – ‘খিদে’কে যে গন্ধ জাগিয়ে তুলতে পারে।
সেই ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধকে লক্ষ্য করে হাঁটতে শুরু করলেই দেখা যায়, মালাগা সমুদ্রের ধারে সারি সারি রেস্টুরেন্টের সামনে পুরনো মাছ ধরার নৌকোর মধ্যে কাঠ জ্বালিয়ে বাঁশ বা বেতের কাঠিতে গেঁথে প্রচুর সার্দিন মাছ পোরানোর যজ্ঞ চলছে।
কাঠ কয়লার আগুনে, সমুদ্র থেকে ধরে আনা বালটি বালটি তাজা সার্দিন মাছ পুড়িয়ে খাওয়ার রেওয়াজ মালাগার খাদ্য সংস্কৃতির এক মুখ্য অঙ্গ। স্পেনে, বিশেষ করে মালাগাতে বহু প্রাচীন কাল থেকেই খোলা জায়গায়, কাঠের আগুনে সার্দিন মাছ গ্রিল করে খাওয়ার প্রচলন আছে। প্রাচীন কালে, সেই কাঠের আগুনের জন্যে আবার বিশেষ ধরণের কাঠ ব্যবহার হত – অলিভ গাছের কাঠ। এখন অবশ্য সাধারণ কাঠই ব্যবহার হয়।
সামার এলেই মালাগার স্থানীয়রা নাকি গ্রিল্ড সার্দিন খেতে ভালোবাসে – স্প্যানিশ সামারের এক অঙ্গ এই রোষ্ট সার্দিন – স্থানীয়রা বলে – el Espeto। কোস্টা দেল সল এক অন্যতম ডেলিকেসি এই গ্রিলড সার্দিন বা el Espeto।
কোস্টা দেল সল অঞ্চলের সমুদ্র তীরে সার্দিন মাছ গ্রিল ও কাঠ কয়লার গন্ধকে স্প্যানিশ সামারের এক প্রতীক বলা যায়। এই অঞ্চলে, সার্দিন মাছ গ্রিল করে খাওয়ার সংস্কৃতি, স্প্যানিশদের মাছ ধরার প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
আগে, সমুদ্রে যখন জেলেরা মাছ ধরেতে যেত, অনেক সময় ওরা তাজা মাছ মাঝ সমুদ্রেই গ্রিল করে খেত, কিংবা ফেরার পথে সমুদ্রের ধারে, কাঠের আগুন জ্বালিয়ে মাছ গ্রিল করে খেত। সেই জন্যে আজও সার্দিনকে ওরা পুরনো মাছ ধরার নৌকোর মধ্যেই কাঠ জ্বালিয়ে গ্রিল করে।
অন্য সময়ে স্প্যানিশরা সার্দিন মাছ খায় না – কারণ মালাগার এই অঞ্চলে সামারেই নাকি সার্দিন মাছ সবচেয়ে ভালো পাওয়া যায়। অন্য সময়ে সার্দিন মাছ গুলো ছোট থাকে।
মাছ ধরার পুরনো নৌকো ভর্তি বালি, তাজা সার্দিন মাছ, কাঠের আগুন, বাঁশ বা বেতের শিক, পরিমান মতো সামুদ্রিক নুন – এই হল মালাগার el Espeto র সঠিক উপাদান। আর মাঝে মাঝে কয়লার আগুনে রোজমেরি, থাইম, বা বে লিফ দিয়ে দেওয়া হয় – কয়ালার পোড়া গন্ধের সঙ্গে সেই মশলা পোড়ানো গন্ধ মিশে যায় – আর সেই মশলা পোড়ানো গন্ধ গ্রিল সার্দিনের মধ্যে মিলে এক অদ্ভুত স্বাদ-গন্ধের সৃষ্টি করে। এই el Espeto তৈরির আবার এক নিয়মও আছে – এক একটি বাঁশের কাঠিতে মাত্র ছয়টা মাছই গ্রিল করা যায়।
যাই হোক, স্প্যানিশ সামারের গরম, কাঠ পোড়া ও গ্রিলড সার্দিনের গন্ধ, সমুদ্রের নোনা হাওয়া – একটু ভেজা, সব মিলিয়ে এই অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যে গন্ধ ও পরিবেশ বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র ঐ কোণেই তৈরি হতে পারে। যে পরিবেশের সাক্ষী হতে ঐ কোণে ঠিক ঐ সময়েই উপস্থিত হতে হয়। খোলা রেস্টুরেন্টে বসে যখন ঐ গ্রিল্ড সার্দিন মাছের অর্ডার দেওয়া হয় – কানে আসে জেলেদের চিৎকার ও কাঠ পোড়ানোর শব্দ, কয়লার শব্দ – ঐ শব্দও যেন পরিবেশটির এক অঙ্গ।
আর সেই কয়লার আগুনে সেঁকা, গ্রিল্ড সার্দিন যখন প্লেটে আসে, সাধারণত, সঙ্গে থাকে এক টুকরো লেবু ও সামুদ্রিক মোটা নুন। আর সঙ্গে পানীয় থাকে ঠাণ্ডা বিয়ার বা কোল্ড ড্রিঙ্কস। খোলা রেস্টুরেন্টে বসে মালাগার সমুদ্র তীরের স্থানীয় জীবন যাপনের ছবি দেখতে দেখতে সুস্বাদু গ্রিল্ড সার্দিন খাওয়া এক মুখ্য টুরিস্ট আকর্ষণ। কিংবা যথার্থ ভাবে, স্প্যানিশ সামারের একটি দিন বলা যায়। যারাই ওখানে যায়, যে দিনটির ছবি, যে দিনটির গল্প নিয়ে ফিরতে ভালোবাসে।
লোভনীয় বর্ণনা!
ধন্যবাদ।