একটা গাছ – তার শরীরের দুই অংশ নিয়ে বড়ই দোটানায়।
যে দিকে তার ডালপালা আকাশের দিকে বিকশিত হয় – সেই দিক চায়, তার প্রত্যেক আঙুলের কলিরা পাক নিত্যনতুন বাতাসের হল্কা।
তাকে আকাশ বলে- এসো, পৃথিবীর প্রত্যেক কোণায় কোণায় নিজেকে ছড়িয়ে দাও।
বাতাস বলে – এসো দূর দেশে নিয়ে যাবো।
কিন্তু, গাছটা পারে না। পারবে না কোনও দিন।
কারণ, তাকে শিকড় বলে – আমাকে উপেক্ষা করো না। শেকড়ের বন্ধন ছেড়ে তুমি নিজেকে কোনওদিনই বিকশিত করতে পারবে না। অন্ধকারের হাজার অন্ধ বাঁধা উপেক্ষা করে, আমি তোমার জন্যে এনেছি প্রানরস। তার কথা মনে রেখো।
সেই সে বছর, যে বছর গাছটার চারিধারে গাঁয়ের ছেলেমেয়ের দল মাদল বাজিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে নেচে নেচে গাইল – পাহাড়তলির সুবাস তুমি মাখলে কেন মাথায়…ও প্রিয়…।
সেই বছর, বৃষ্টির পরেই গাছটা ছেয়ে গেল ফুলের কলিতে – রাশি রাশি লাল ফুলের হাসিখুশি দল, বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে শুধুই আনন্দে ঘাড় নাড়া দেয়। যেন একদল পাঠশালা ছুটি হওয়া ছেলেমেয়ে।
গাছের কাছে প্রতিদিনই আসে ছেলেমেয়ের দল, মেয়েরা ফুল গোঁজে খোঁপায় – ঝুড়ি ভরে ভরে নিয়ে যায় – ঘর সাজাবে।
সবচেয়ে ভালো মাদল বাজানো ছেলেটা – সবাইকে লুকিয়ে একখানা ফুল তুলে নেয় ভুঁই থেকে। তারপর হাতে তুলে নেয় তার বাঁশি – ফুলের দলের মাথা দোলানোর সঙ্গে মিশে যায় তার বাঁশির সুর।
একখানা ভ্রমর; মালির হাতে বোনা বাগানের ফোঁটা কত ফুলেই না সে চরেছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। একদিন সেই ভ্রমর দিক্ভ্রষ্ট তারার মত কেমন করে যেন ধরা পড়েছিল – গাছটির রঙ রূপের ঝাঁপিতে। সেই ভ্রমর রোজ রোজই দেখে যেত গাছটিকে – সে ভালোবেসে ফেলেছিল।
সময়টা ছিল বসন্ত। শীতের চিন্তা ছিল না ভ্রমরের। ভ্রমর গাছটার সঙ্গে কথা বলত – বাতাসের ভাষায়। সভ্যসমাজে সেই ভাষা চলে না, সেই কথা কেউই বোঝে না। হাজার ফুলের ভিড়েও ভ্রমর এসে রোজ রোজ দেখে যেত গাছটিকে।
শীত আসে প্রতিবছরের মতই। এবারো শীত এলো, কুয়াশার হাত ধরে। শীতের রুক্ষ দিন গুলো গাছের পক্ষে বড়ই কঠিন। নিঃস্ব, রিক্ত, গাছটার পক্ষে ভ্রমরকে ‘বন্ধুত্ব’ দেওয়া ছাড়া আর কিই বা দেবার আছে?
কনকনে শীতে গাছ, তার শুকনো ডালপালা ঝরিয়ে দেয়। গরিবগুর্বোরা তা জ্বেলে বড় আরাম পায় – হাত পা তাতিয়ে নেয়। রিক্তের এ মহান দান, শুধু মনে রাখে গভীর রাতের কালো আকাশ।
মানুষ কথা বলে। গাছ শোনে। গাছটা শুনতে পায় ভাসা ভাসা – বাতাসে সেই কথা ভেসে আসে – এখানে সড়ক হবে।
কোন এক মিঠে রোদ্দুর মাখা সকালে জরীপ বাহিনী আসে। মৃত্যুর নির্মম পরোয়ানা শীতলতা আনে। এখান দিয়ে সড়ক হবে। বহু গাছের সঙ্গে এই গাছটাও ‘বাতিল’। এ পথ গিয়ে মিলবে কোন এক সভ্য নগরীতে।
নির্মম এ কথাটা মোটেও ছিল না সংগোপনে। মেয়েদের দল তেরছা ভাবে, করুণ দৃষ্টিতে গাছটাকে দেখে। সেই মাদল বাজানো ছেলেটা অনুভব করে, চাপা কোন এক অব্যক্ত বেদনা। মৃত্যুপথযাত্রী গাছটাকে যে দূরের ঐ গ্রামের ছেলেমেয়েরা সত্যিই বড় ভালোবাসতো।
বাতিল করার দিনটির খুব দেরী ছিল না। কাজ শুরু হয়েছে – দূরে। বাতাসে তার শব্দ ভাসে, ভাসে গন্ধ।
ভ্রমরের কান্নায় বাতাস আর্দ্র হয়। গাছ কাঁদে না। শিশিররা টুপটাপ ঝরে পড়ে তার ডালপালা থেকে – ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুর মত, চাপা কান্নার মত। সেই রাতের বাতাসে সেদিন ছিল আশ্চর্য শীতল নিস্তব্ধতা, এক চাপা হাহাকার।
“পাখির ঠোঁটের ধরা, দূরদূরান্তে ছড়ানো আমার বীজ। অঙ্কুরিত হবে একদিন, তুমি কেঁদো না। হোক উষ্ণতার প্রকাশ” – এই ছিল ভ্রমরকে গাছের করা শেষ সম্ভাষণ।
সেদিন, শিকড়ের অন্তিম টানেতে ধরাশায়ী বাতিল গাছটার শেষ বয়ান হয়তো ছিল – সে হবে আকাশের চিরপ্রকাশ্যমান তারাদের মত। ভুলবে নাকো কেউই। থাকবে না কোন শেকড়ের টান। বিস্মৃতির ওপারে তার হবে চির আত্মপ্রকাশ।
কিন্তু, চিরকাল সংগোপনে যা ছিল তা – ধরাশায়ী গাছের কোটরে অনাবিষ্কৃত কোন অনামা ভ্রমরের শব – যে খুবই ভালবেসেছিল গাছটাকে।
ঘড়ির কাঁটা ঘোরে পুব থেকে পশ্চিমে। ধীরে ধীরে কেটে যায় আরও একটি দিন, এবং তারপর আরও আরও কত দিন। মানুষ কত কথাই না ভোলে।
কালো মসৃণ চকচকে রাস্তার সভ্যবিলাসে এখন শুধুই উত্তাপ। মেয়েরা গাছটাকে ভুলে গেল – ওরা হাত ধরাধরি করে আজও হাঁটে, তবে রাস্তার বুকে, সঙ্গে নিয়ে শহরের চটুল গানের কলি।
গাঁয়ের পথে মাদল বাজানো সেই ছেলেটি! মসৃণ রাস্তার বুকে এসে বিদায় নেয় – বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে – শহরে সে যাবে – কাজে।
তারপর ঘড়ির কাঁটাটা কোনও দিনই আর পশ্চিম থেকে পুবে – উল্টো দিকে ঘোরে নি – কারণ মানুষ ভোলে। সবাই গাছটাকে ভুলে গেছে।
- Written By – Dr. S. Chowdhury