প্যারিসের নদী সেইন কে নিয়ে যুগ যুগ ধরে কতো রোম্যান্টিক গান বাঁধা হয়েছে, কতো ছবি ছবি আঁকা হয়েছে, পৃথিবীর কতো শিল্পীর তুলির প্রেরণা এই নদী। ফ্রান্সের নানা সময়ের ইতিহাসের সাক্ষী এই নদীকে ঘিরে কতোই না গল্প। তাই, সেইন নদীকে প্যারিসের ধমনী বললেও ভুল বলা হবে না। তারপর তো আছে, সেইনের উপরে শতাব্দী প্রাচীন সেতু গুলো। সেইন নদীর উপরে সেই শতাব্দী প্রাচীন অলংকৃত সেতু গুলো যেন আরও সৌন্দর্য যোগ করে।
আর এই সেইন নদীর পাশের বাঁধানো রাস্তা ও সেতু ধরে হাঁটতে হাঁটতে, সেইনের উদার রূপ দেখতে দেখতে বার বার প্যারিসের এক নতুন রূপ ধরা দেয় – যে রূপের সাক্ষী হতে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ প্যারিসে আসে। ফ্রান্সের অন্যতম দীর্ঘ এই নদীটি Le Havre এর কাছে গিয়ে ইংলিশ চ্যনেলের সঙ্গে মিশেছে।
শতাব্দী প্রাচীন প্যারিসের মতো বড় শহরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে প্যারিসের সমস্ত গ্লানি ধুইয়ে দিতে দিতে সেইন নদী নিজেও কম দূষিত হয় নি। সেইনের গভীর কালো জল নাকি নানা ধরণের ভারী পদার্থে বেশ ভালো রকমেই দূষিত। আর মাঝে মাঝে তাই সিয়েন নদী প্যরিসের উপরে সেই দূষণের প্রতিশোধও নেয়। প্যারিসের গায়ে সেইন নদী মাঝে মধ্যে অবিরাম স্রোতের বন্যা আনে। তবে, সিয়েন নদীকে ভালো রাখার জন্যে প্যারিস কতৃপক্ষ সমস্ত রকমের চেষ্টা করে চলে, শোণা যায়, যে দূষণের জন্যে মাছেরা সেইন নদী ছেড়ে চলে গিয়েছিল – তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এসেছে – যেমন Atlantic salmon সেইন নদীতে ফিরে এসেছে।
প্যারিসের বুকে বন্যা – পাশেই ল্যুভরে মিউজিয়ামের প্রচুর শিল্পকলা – ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সহজেই অনুমেয়, তাই ২০০৩ এ সেইনের বুকে বন্যার আশঙ্কায় প্রায় এক লক্ষের কাছাকাছি শিল্প ও পেইন্টিং নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ল্যুভরের জন্যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই ছিল প্রথম শিল্প স্থানান্তকরন প্রক্রিয়া।
সেইন নদীকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, সে দিনটি ছিল ডিসেম্বরের কণকণে ঠাণ্ডার এক মেঘলা দিন, বৃষ্টির জলে ফুলে ফেঁপে ওঠা সেইনের ঘূর্ণি স্রোত ছুঁয়ে বয়ে আসছিল হাড় হিম করে দেওয়া এক বাতাস। তারপর তো সেইনকে আবার দেখেছি, বার বার দেখেছি – আর যতবারই দেখেছি এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছে – এক আভিজাত্যময় বিশালতার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার এক অনুভূতি, যে অনুভূতি পৃথিবীর বুকে নিজের ক্ষণিক উপস্থিতিকে, নিজেকে, নিজের অস্তিত্বকে অতি ক্ষুদ্র বলে মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, জীবনের বয়ে চলার সেই সত্যকে।