ইন্দ্রদা পার্কে ঢোকার মুখে টিকিট কাটার সময় যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম – এই পার্কে কি কি দেখার আছে? খাকি পোশাক পড়নে লোকটি নিতান্তই তাচ্ছিল্ল ভরে বলেছিল – সবই আছে, পাখি, হরিণ, বাঘ, শেয়াল, ডাইনোসর সবই আছে, গেলেই দেখতে পাবে।
আমরাও কুড়ি টাকার টিকিটে বিশেষ আর কি দেখা যাবে ভাবতে ভাবতে, রাস্তার দু’পাশে বগেনভেলিয়া ফোঁটা নির্জন রাস্তা ধরে মূল পার্কের ভেতরের দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলাম – অবশ্য রাস্তার দু পাশের খোলা জায়গায় ময়ূররা নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তবুও, খুব একটা বিশেষ কিছু আশা না করেই ইন্দ্রদা পার্কে পৌঁছে গিয়েছিলাম – কারণ, সেবার মাইসোরের বার্ড সেঞ্চুয়ারির অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ ছিল, মহা আড়ম্বরে মাইসোরের বার্ড সেঞ্চুয়ারিতে গিয়ে কোন কাক শালিকও নজর পড়ে নি – অবশ্য কয়েকটা পাখির পাথুরে মূর্তি চোখে পড়েছিল। মাইসোরের বার্ড সেঞ্চুয়ারিতে দেখেছিলাম প্রচুর মানুষের আনাগোনা, চিৎকারে পাখিদের থাকা সত্যিই খুব মুশকিল ছিল। যাইহোক, গুজরাটের ইন্দদা পার্ক কিন্তু সেই তুলনায় খুবই নির্জন, শান্ত।
সাধারণত গুজরাটের মানুষ রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট, ফ্ল্যাট, বাংলো, স্টক মার্কেট, গিফট সিটি, স্মার্ট সিটি, ব্যবসা বানিজ্য, ফরেন ইনভেস্টমেন্ট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে বেশ ভালোবাসে। আর সেই ভালোবাসার প্রমান যে কোন গুজরাটি মানুষের জটলার কথাবার্তা, আলাপ আলোচনার মধ্যে কান পাতলেই বোঝা যায়। এদের কাজে ও কথায় সর্বদা লক্ষ্মী দেবীর বসবাস – আর সেই রকম এক জায়গায় যে জঙ্গল, ডাইনোসর ও পশুপাখিরা গুরুত্ব পাবে – তা এক্কেবারেই আশা করা যায় না।
তাই, রাজধানী গান্ধীনগরের একদম কেন্দ্রেই চারশো হেক্টর জমির উপরে তৈরি ইন্দ্রদা নেচার পার্কের ডাইনোসর, পশুপাখিরা অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়।
বিশাল এই নেচার পার্ক হেঁটে দেখতে অন্তত তিন থেকে চার ঘণ্টা তো লেগেই যায়। এই নেচার পার্ককে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে – ডাইনোসর পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও মুক্ত চিড়িয়াখানা।
এক দিকে প্রাগৈতিহাসিক পার্ক – ডাইনোসর পার্ক – যেখানে ডাইনোসরের বিশাল বিশাল মূর্তি দেখা যায়। এই ডাইনোসর পার্কে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম hatchery of dinosaur eggs পাওয়া গিয়েছিল। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠিত এই পার্ক ভারতবর্ষের একমাত্র ডাইনোসর মিউজিয়াম। এই পার্ককে ভারতবর্ষের জুরাসিক পার্কও বলা হয় – যদিও এখানে পাওয়া ডাইনোসরের ফসিল জুরাসিক পরবর্তী সময় ‘Cretaceous’ যুগের। ডাইনোসর পার্কের গাছ গুলোও যেন একটু প্রাগৈতিহাসিক।
ডাইনোসর পার্কের বাঁধানো রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখি – শেষ বিকেলের আলোয় জলের ধারে কচ্ছপের রোদ পোহানো, বা ডাইনোসরের হাঁ করা মুখের ভেতরে পায়রা দম্পতীর সুখের বাসা, কাঠবেরালির চাঞ্চল্য, শুনি হাজার পাখির কূজন। সব মিলিয়ে এই প্রাগৈতিহাসিক পার্ক বর্তমানের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর।
ডাইনোসর পার্ক থেকে বেড়িয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে সিধে গভীর জঙ্গলের ভেতরে শুরু হয়ে যায় খোলা চিড়িয়াখানা। ময়ূর, টিয়ে, বাজ, পেলিকান থেকে শুরু করে আরও নানা প্রজাতির পাখির বসবাস এই অংশে – অনেকের তো আবার নামও জানা নেই।
একদিকে, বিশাল খোলা চিড়িয়াখানায় স্বাস্থ্যবান হরিন দলের পাশেই বাঘের বিশাল খাঁচা – শেষ বিকেলের আলোয় হরিণ দলের দিকে উদাস ভাবে তাকাতে তাকাতে বাঘের সময় দিব্যি কেটে যায় – চিড়িয়াখানায় আগত মানুষদের আনাগোনার দিকে ভ্রূক্ষেপও করে না সে।
গান্ধীনগরের এই বিশাল পার্কের চরিত্রে বেশ এক জঙ্গুলে, আদিম, রুক্ষ, নির্জন ভাব আছে – নভেম্বরের শুরুতে এখানের জঙ্গলে শুরু হয়ে যায় হালকা শীতের প্রস্তুতি। এখানে জঙ্গলের পথে চলতে চলতে দেখা যায় – বন ময়ূর তার অপূর্ব রঙিন পালক ফেলে দিয়ে রাস্তার ও পাশের জঙ্গলে মিলিয়ে যায় – প্রকৃতির রুক্ষ শ্যামল, রঙিন রূপ নিয়েই গুজরাটের এই ইন্দ্রদা পার্ক।