ভারতবর্ষের এক একটি রাজ্য যখন ইংরেজরা নিজের অধীনে করে নিচ্ছিল – ঠিক তখুনি মাইসোরের টিপু সুলতান রীতিমত রুখে দাঁড়িয়েছিল – ফরাসীদের কাছ থেকে রণনীতি শিক্ষায় শিক্ষিত টিপু সুলতান ইংরেজদের রীতিমত চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।
শত্রুর শত্রু, মানে বন্ধু – সেই নিয়ম অনুসারে টিপু সুলতান নেপোলিয়ানের বন্ধু ছিল। সেই সময় প্রায় কুড়ি বছর ধরে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। আর ইংরেজদের সঙ্গে মাইসোরের প্রথম যুদ্ধেই টিপু নিজের ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল – তারপর তো পরপর তিনটে যুদ্ধে ব্রিটিশ আর্মি টিপু সুলতানের কাছে হেরে গিয়েছিল। ব্রিটিশদের পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল টিপুর তৈরি রকেট।
টিপু সুলতানকে পৃথিবীর প্রথম যুদ্ধ রকেটের জনক বলা যায়। সে ছিল এক অদ্ভুত রকেট – সেটা দেখে ব্রিটিশ সেনারা প্রথমে চমকে গিয়েছিল, টিপুর রকেটের আঘাতে ব্রিটিশরা এতোই আহত ও নিহত হয়েছিল যে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
টিপুর সেই রকেট এতোই প্রভাবশালী ছিল যে নেপোলিয়ান বোনাপার্টও তার যুদ্ধকালীন সময়ে টিপু সুলতানের সেই বিখ্যাত রকেট ব্যবহার করেছিল। এমনকি, ব্রিটিশরা মাইসোরের শেষ যুদ্ধে টিপুকে হারিয়ে সেই রকেট বাজেয়াপ্ত করেছিল – এবং রীতিমত সেই রকেট নকল করেছিল। পরবর্তী কালে আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে ব্যবহারও সেটা করেছিল। টিপুর সেই রকেটের নমুনা আজও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দেখা যায়।
কেমন ছিল সেই রকেট? আসলে, আগে বাঁশের খোলের মধ্যে বারুদ ঢুকিয়ে দিয়ে ছোড়া হত, তাতে বারুদের পরিমাণ কম হোতো ও সেই রকেট বেশিদূর যেতেও পারতো না। টিপু সুলতান সেই জায়গায় লোহার তৈরি নলে বারুদ ঢুকিয়ে দিয়ে, রকেটের লেজে বসিয়ে দিল পাতলা লকলকে ধারালো তরোয়াল – টিপুর তৈরি সেই তরোয়াল যুক্ত রকেট প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত পাড়ি দিত।
বোঝাই যায়, সেই মারাত্মক রকেট তীব্র গতিতে ব্রিটিশ আর্মির মধ্যে গিয়ে কি মারাত্মক ক্ষয় ক্ষতি করতে পারে।
যাইহোক, মাইসোরের Srirangapatna য় টিপু সুলতানের সামার প্যালেসে গিয়ে টিপু সুলতানের তেমনি কিছু যুদ্ধ জয়ের ছবি দেখা যায় – যদিও নোনা ধরে ছবি গুলোর দশা মলিন, কোথাও কোথাও একটু রংচটা, যত্নের অভাব কিন্তু, ছবি গুলোয় সেই সময়ের মাইসোরের প্রথম যুদ্ধ জয়ের উল্লাস স্পষ্ট বোঝা যায়।
টিপু সুলতানের সঙ্গে নেপোলিয়ানের বন্ধুত্ব ইংরেজরা খুব একটা ভালো চোখে দেখছিল না – মাইসোরের চতুর্থ যুদ্ধের আগে নেপোলিয়ান টিপুকে প্রশংসা করে এক চিঠি পাঠিয়েছিল। কিন্তু, সেই চিঠি টিপুর হাতে আর পৌঁছয় নি, ব্রিটিশ গুপ্তচরের হাতে পড়েছিল – আর সেই চিঠি দেখে ব্রিটিশ আর্মি টিপু সুলতান ও নেপোলিয়ানের যুগলবন্দীর আশঙ্কা করে টিপুর বিরুদ্ধে আরও বিশাল এক যুদ্ধের আয়োজন করতে শুরু করল।
এদিকে, টিপুকে নেপোলিয়ান সেনা দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল – কিন্তু, ফরাসী বিপ্লব, রাজা রানীর হত্যা সব নিয়ে ফ্রান্স তখন উত্তাল ছিল, তাই, নেপোলিয়ান আর টিপুকে সাহায্য করতে পারলো না। এদিকে, ব্রিটিশ আর্মি চারিদিক দিয়ে টিপুর সেনাকে কোন ঠাসা করে দিয়েছিল।
সেই সময় ব্রিটিশ আর্মির গভর্নর জেনারেল ছিল Arthur Wellesley , তার নেতৃত্বে ব্রিটিশ আর্মি মাইসোরের চতুর্থ যুদ্ধে টিপু সুলতানকে হারিয়ে দেয়। সেই একই Arthur Wellesley তার কয়েক বছর পরে ওয়ারটার্লু যুদ্ধে নেপোলিয়ানকেও হারিয়ে দেয়।
যাইহোক, ইতিহাসের গল্পকে সবাই যে যার নিজের মতো করে দেখে, নিজের মতো করে সাজায় – কোন দেশে নেপোলিয়ান পরাজিত হয়েও নায়ক, কোন দেশে টিপু সুলতান পরাজিত হয়েও নায়ক, কোন দেশে Arthur Wellesley নায়ক।