বোহেমিয়ার জঙ্গলের এক ছোট পাহাড়ি তন্বী ঝর্ণা নদী – ভালতাভা, প্রাগের কাছে এসে বিশাল এক নদী হয়ে যায়, বিস্তারিত হয়ে যায়, হয়ে যায় পরিণত। আবার প্রাগ ছেড়ে যেতে যেতে, Labe নদীতে মিশে যাওয়ার আগে, হাঁসুলী বাঁকের মতো মারাত্মক এক বাঁক নেয় – যেন মধ্যগতিতে এসে ভালতাভা আবার নিজের গতিপথ পাল্টানোর ক্ষমতাকে শেষবারের মতো যাচাই করে নিতে চেয়েছিল।
হাজার বছরের প্রাচীন প্রাগ শহরকে সমান দুই অংশে ভাগ করে ভালতাভা বয়ে চলে, মাঝ বরাবর। প্রাগের মানুষের জীবন যাপন, জীবন ধারণ এই ভালতাভা নদীকে ঘিরেই চলে – নদীর ঠিক পাশেই বসে দৈনন্দিন স্থানীয় বাজার, সুভ্যেনিরের দোকান। মরশুমে, নদীর বুকে ভেসে বেড়ানোর জন্যে ঘাটে টুরিস্টের আনাগোনা, ভাসমান রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া, ওয়াটার স্পোর্টস সব নিয়েই প্রাগের ভালতাভা নদীর তীর বেশ সরগরমই থাকে।
এক পড়ন্ত বিকেলে প্রাগের ভালতাভা নদীর বাঁধানো ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে শুধু যে এই প্রাচীন শহরের জীবন ধারার সাক্ষী হয়ে থাকা যায়, তা নয়, সেই সঙ্গে প্রাগের প্রকৃতিকেও অনুভব করা যায় – মাঝ নদীতে সিগালের মাছ ধরার ব্যস্ততা, রাজহাঁসের গ্রীবা বাঁকিয়ে ভেসে চলা, সব দেখতে দেখতেই এগিয়ে যাওয়া যায়।
প্রায় চারশো কিলোমিটারের উপরে দীর্ঘ এই নদী চেক রিপাপ্লিকের সবচেয়ে দীর্ঘ নদী – তাই এই নদীকে চেকের জাতীয় নদী হিসাবেও জানা যায়। দীর্ঘ এই নদীর জলকে বাগে আনার জন্যে নদীর বুকে বেশ কয়েকটা ড্যাম তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রচুর সেতু, শুধু প্রাগেই তৈরি হয়েছে আঠারোটা সেতু, চেকের মানুষের প্রয়োজনীয় জলের উৎস এই নদী – সবই ঠিক চলে।
তবুও চেকের মানুষের মনে যেন এই নদীকে ঘিরে এক ভীতি রয়ে যায়, যেন কোথাও এক প্রশ্ন থেকেই যায়। সত্যিই কি প্রকৃতিকে, নদীকে, উত্তাল নদীর জলকে পোষ মানানো যায়? বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, টেকনোলোজি – সব কিছু নিয়েও যেন মানুষ প্রকৃতির সমস্ত বিনাশকারী ক্ষমতার কাছে হেরে যায়। আর সেই হেরে যাওয়াটা যেন আরও স্পষ্ট হয়, যখন সেই শান্ত ভালতাভা নদী ফুলে ফেঁপে দু’কূল ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ভাসিয়ে দেয় প্রযুক্তির সমস্ত অহংকারকে।
আমরা প্রাগ থেকে ফিরে আসার পরেই শুনলাম, ভালতাভার নদীতে বন্যা এসেছে, প্রাগের ঐতিহাসিক শহর কেন্দ্রকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে, চার্লস ব্রিজের উপর দিয়ে ভয়ংকর বেগে ভালতাভা ফুঁসতে ফুঁসতে বয়ে চলেছে। প্রাগ শহরের ভেতরে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারকাজের জন্যে সামরিক বাহিনী নেমে পড়েছে – ঐতিহাসিক সুন্দর শহরটির জীবন যাত্রা যেন মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে যায়। তবে, আবার কিছুদিনের মধ্যেই নদী ও মানুষ তার নিজস্ব জীবনের নিজস্ব স্রোতে ফিরে যায়, মোহনার দিকে বয়ে যেতে ব্যস্ত হয়ে যায় – আর, সেটাই সত্য।