ঘন নীল সমুদ্রের পাশে প্রাচীন এক দুর্গ শহর, শহর ঘিরে মধ্যযুগীয় এক দেওয়াল – যে দেওয়াল বারো থেকে সতেরো শতাব্দীর মধ্যে তৈরি হয়েছিল, যে দেওয়াল ইউনেস্কোর হেরিটেজ লিস্টে স্থান পেয়েছে, যে বিশাল দেওয়ালের উপরে আজও হাঁটার ব্যবস্থা আছে, যেখানে সমুদ্রের ফুরফুরে হাওয়া তাজা করে দেয় মন-প্রান, সামারের উজ্জ্বল নীল সকাল – সব মিলিয়ে ক্রোয়েশিয়ার এই সমুদ্র শহরের কাছে পৃথিবীর টুরিস্টদের আকর্ষণ করার, এক স্মরণীয় ভ্রমণ স্মৃতি উপহার দেওয়ার সমস্ত উপাদানই মজুত আছে। শুধু নব্বইয়ের দশকের যুদ্ধ বিগ্রহই যা একটু আড়াল করে ধূসর করেছিল এই শহরকে, কিন্তু, আজ আবার নতুন ভাবে, নতুন করে সেজে উঠছে এই সমুদ্র শহর।
দুব্রভনিক সিটি ওয়ালে ওঠার জন্যে, সকালের আলো ফোঁটার সময় থেকেই টুরিস্টের আনাগোনা শুরু হয়ে যায় – কারণ সূর্য তেতে উঠলে, সঙ্গে প্রাচীন এই দেওয়ালের পাথর গুলোও তেতে ওঠে। তখন অনেকের জন্যে, এই দীর্ঘ পথে চলা একটু মুশকিল হয়ে পড়ে।
বিশাল এই দুর্গ প্রাচীরের উপরে যাওয়ার জন্যে চারটে গেট আছে – দুটো বন্দরের দিকে ও দুটো শহরের দিকে, রীতিমত টিকিট কেটে তবেই উপরে যাওয়ার ছাড়পত্র পাওয়া যায়, তবে, যতক্ষণ ইচ্ছা উপরে থাকা যায়, হাঁটা যায়। প্রায় আশি ফুট উঁচু এই দেওয়ালে চড়ার খাড়া সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে শুরু হয় দেওয়ালের পথ ধরে হাঁটা – সঙ্গে ডানদিকে চলে উদার নীল সমুদ্র আর বাঁ দিকে প্রাচীন দুভ্রভনিক শহর ও সামঞ্জ্যস্য পূর্ণ নয়নাভিরাম লাল টালির ছাদের প্রাচীন বাড়ী।
যুদ্ধের সময়ে বোমার আক্রমনে অনেক বাড়ীর ছাদ উড়ে গিয়েছিল, যুদ্ধ শেষে দুভ্রভনিকের স্থানীয় মেয়র সমস্ত বাড়ীর ছাদ একই রঙের টালি দিয়ে সাজিয়ে দেয় – তাই দেওয়ালের উপর থেকে যে যে বাড়ীর ছাদে নতুন টালি দেখা যায়, তা সহজে অনুমান করে নেওয়া যায়, যে, বাড়ীগুলোকে যুদ্ধের পরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
প্রাচীরের এই দীর্ঘ পথে একটু দূরে দূরেই প্রাচীন কামান সাজানো, কিছুদূর চলার পরেই চোখে পড়ে গম্বুজাকার অবজারভেশন টাওয়ার। এখানে প্রাচীরের এক দিকে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙ্গে অবিরত – পৃথিবীর কোথাও বোধহয় একই সঙ্গে সমুদ্র ও দুর্গের এমন মেলবন্ধন দেখা যায় না। পথ চলতে চলতে সমুদ্রের এলোমেলো মাতাল হাওয়া কান ছুঁয়ে দিয়ে যায়। মাঝ পথে প্রাচীরের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের নীল ও দুব্রভনিক শহরের লাল টালির ছাদের সৌন্দর্যে চোখ ডুবে যায়।
পৃথিবীর পথে মানুষের পথ চলার চিহ্ন ও আদি সমুদ্রের কি অপূর্ব বন্ধুত্ব হয়, হতে পারে – তা এখানে না এলে, এই পথে না হাঁটলে হয়তো অজানাই থাকতো, অদেখাই থাকতো। তাই দুভ্রভনিকের দুর্গ প্রাচীরে পথে হাঁটার অভিজ্ঞতা যে আমাদের হৃদয়ের বড় কাছের এক অভিজ্ঞতা।