সেদিন লাটভিয়ার রাজধানী শহরের রাস্তায় ছিল প্রচুর ভিড়, সামারের সেই উজ্জ্বল দিনে রিগার রাস্তায় রাস্তায় দেখি সকাল থেকেই প্রচুর স্থানীয় মানুষ – সাধারণত ইউরোপের পথে এমনি দৃশ্য বিরল।
সেদিন রিগার রাস্তা থেকে শুরু করে পার্ক, শহরের স্কোয়ার সবই ছিল স্থানীয় সুন্দরীদের দখলে – তাদের মাথায় ছিল ফুলের সাজ, মুখে ছিল উজ্জ্বল প্রাণখোলা হাসি, পড়নে ছিল সুন্দর জাতীয় পোশাক, আর গলায় ছিল গান, বাতাসে ছিল সুরের ছোঁয়া – আর সেই দিন রিগার এক দল উৎসব মুখর মানুষের একদম মাঝে পৌঁছে গিয়ে আমাদের মতো বহু টুরিস্টই পথ হারিয়েছিল।
তবে বেড়াতে এসে, এমনি উজ্জ্বল বিদেশী উৎসবের মাঝে গিয়ে যেন পথ হারাতেই ভালো লাগে। ভিড়ের মধ্যে এক আমেরিকান ভদ্রলোক বহুক্ষণ ধরেই দল ছাড়া হয়েছিলেন, পথ ভুলে গিয়ে একে ওকে রাস্তাও জিজ্ঞেস করছিলেন, কিন্তু, চলার পথে ক্যামেরায় চোখ রাখতে এক্কেবারেই ভুলছিলেন না – সেই দিনে এমনি ছিল মানুষের স্বাধীন উৎসবের রং। রিগার এই উৎসব মুখর দিনের উজ্জ্বল ছবি, হাসি সবই ছিল তার অমূল্য ভ্রমণ সম্পদ।
আমরাও যে ঠিক এই উৎসব উপলক্ষ্যেই রিগায় পৌঁছে ছিলাম তা নয় – তাই রিগার জাতীয় দিবসের এই উৎসব আমাদের কাছেও ছিল চলার পথের এক বাড়তি পাওনা – দিনটি ছিল রিগার স্বাধীনতা দিবস পালনের দিন।
আসলে, লাটভিয়ায় বছরের দুই দিন স্বাধীনতা দিবস পালন হয়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের শেষে জার্মানী ও রাশিয়ার দখল মুক্ত হয়ে লাটভিয়া দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধীন ছিল । কিন্তু, আবার ১৯৪০ এ রাশিয়া লাটভিয়া দখল করে নেয়, পরে সমস্ত বাল্টিক দেশ একানব্বই এ স্বাধীন হয়। আর সেই স্বাধীনতা দিবস লাটভিয়ার জাতীয় দিবস হিসাবে পালন হয়। আর সেই উৎসব পালনও এখানে স্বাধীনতার মুক্ত প্রকাশ, রিগার এই উৎসবে যোগ দিতে রিগার নানা দিক থেকে দলে দলে মানুষ এসে জমায়েত হয় – গান গেয়ে, রঙিন পোশাকে, ফুলের মুকুটে পালন হয় এই উৎসব।
রিগার মতো এক ঐতিহাসিক শহরের গলিতে, স্কোয়ারে, রাস্তার মোড়ে সব জায়গায় যখন একদল স্থানীয় মানুষ, ট্র্যাডিশনাল প্রাচীন পোশাক পড়ে ঘোরাফেরা করে – শহরের দৃশ্যে যেন আরও বেশী ঐতিহাসিকতা যোগ হয়, সৌন্দর্য যোগ হয়। মনে হয়, যেন সত্যি ইতিহাসের কোন এক পাতায় বিচরণ করছি। তাই, ভিড় অনুসরণ করে রিগার শহরের এই গানের উৎসবের অংশীদার হয়ে যাই।
তারপর, যুগের পর যুগ ধরে, প্রতি বছর এমনি ঝকঝকে উজ্জ্বল নীল দিনে এমনি করেই হাসিমুখে ফুলের মুকুট পড়ে, রিগার মানুষ স্বাধীনতার উৎসব পালন করবে আর আমরা ভ্রমণ স্মৃতির পাতা খুলে দেখবো – আমরাও একদিন স্বাধীনতার সেই উজ্জ্বল উৎসবের ভিড়ে মিশে ছিলাম, হারিয়ে গিয়েছিলাম রিগার সেই ঐতিহাসিক গলির মোড়ে।
জীবন যদি হয় যাত্রাপথের ছবি – আমি বলব, আমাদের জীবনের এই যাত্রায় রয়ে গেছে উৎসব মুখর উজ্জ্বল দিনের কিছু অচেনা মানুষের হাসিমুখের উজ্জ্বল কিছু ছবি। যে ছবি আনন্দের, যে ছবি স্বাধীনতার, যে ছবি স্মৃতিমেদুরতার।