ইলিশ মাছ খেতে হলে যেমন সন্তর্পণে কাঁটা বেছে খেতে হয়, তেমনি ইউরোপ ভ্রমণের সময়ে কিছু সতর্কতা অতি অবশ্যই পালন করতে হয়। প্রথমেই যেমন, সমস্ত টাকা পয়সা, কাগজ পত্র, ভিসা, পাসপোর্ট ভেতরের পকেটে রাখা – কারণ ইউরোপের প্যারিস থেকে শুরু করে বার্সিলোনা, পিসা, মিলান, নেপলস, ভেনিস নিয়ে বেশ কয়েকটি শহর ছিঁচকে চোর, পকেটমারদের স্বর্গরাজ্য। যেন বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মের মতোই ইউরোপে যেখানে টুরিস্ট বেশী সেখানেই পকেটমার। বিদেশ বিভূঁইয়ে টাকা পয়সা হারিয়ে যাওয়ার চেয়েও বেশী বিপজ্জনক কাগজ পত্র হারিয়ে যাওয়া – আগে তাও পকেটমাররা টাকা পয়সা নিয়ে পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি কাগজপত্র যেখানে পকেটমারি হয়েছে, সেখানের ডাস্টবিনে ফেলে দিত – এখন নাকি পরিচয় পত্র গুলোও চড়া দামে চোর বাজারে বিক্রি হয়।
যাইহোক, দ্বিতীয় সতর্কতা, বিশেষ করে প্যারিসের রাজপথে, আইফেল টাওয়ার, অ্যালেকজান্ডার ব্রিজের পথে, কখনোই কেউ সোনার আংটি দেখিয়ে যদি বলে – এটা কি আপনার? দেখার ছলে ভুলেও হাতে না নেওয়া।
আশ্চর্য, আংটি কি কখনও কারোর আঙ্গুল থেকে খুলে রাস্তায় পড়ে যায়? সাধারণত দল বেঁধে অল্প বয়সী বা মধ্যবয়সী মহিলারা এই আংটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। আমাদের সঙ্গেই এই ঘটনা হয়েছে – অ্যালেকজান্ডার ব্রিজের পথে একদল অল্প বয়সী মেয়ে রাস্তা থেকে এক চকচকে আংটি তুলে জিজ্ঞেস করল – এটা তোমার?
আমি কিন্তু আগেই দেখে নিয়েছিলাম, ওদের মধ্যে একজন আংটিটি প্রথমে রাস্তায় ফেলল, অন্য আরেকজন কুড়িয়ে নিয়ে আমাদের সামনে এলো। আংটি হাতে নিয়ে মহিলারা কিন্তু বার বার বলে যায় – এই আংটি নিশ্চয় তোমার, একবার হাতে নিয়ে দেখো। এই ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে, না দেখেই কিন্তু এড়িয়ে যেতে হয়, না বলতে হয় – একবার ভুল করে যদি কেউ আংটি হাতে নিয়ে নেয়, ওরা পয়সা চায়, বলে – তোমার আংটি আমি খুঁজে দিলাম, এখন টাকা দাও। স্বভাবতই কেউ এই ক্ষেত্রে টাকা দিতে চায় না – ব্যস শুরু হয়ে যায় ওদের ভাষায় ওদের বদখৎ চিৎকার, ওদের ভাষায় গালি গালাজ, কোন কোন ক্ষেত্রে তো টুরিস্টদের সঙ্গে হাতাহাতি পর্যায়েও পৌঁছে যায়।
প্যারিসে আমাদের চোখের সামনেই অন্য এক বয়স্ক টুরিস্টের সঙ্গে একই ধরণের আংটি ঘটনা গালিগালাজ পর্যায়ে পৌঁছে গেল, টুরিস্টরা সাধারণত কিছু বলে না, কারণ ওদের গালিগালাজ, চিৎকারের ভাষাই তো বোঝা যায় না – সম্পূর্ণ অবোধ্য, অবশ্য কেউ কেউ ইংলিশেও চিৎকার করে – সত্যি বেড়াতে এসে এই ধরণের ঘটনা বেড়ানোর স্বাদ বেশ তেতো করে দিতেই পারে। তাই, প্রথমেই ওদেরকে এড়িয়ে চলা ভালো।
অনেকের মুখেই প্যারিসের এই আংটি র্যাকেটের কথা শুনে জানতে ইচ্ছে করল, ওরা কারা, গালিগালাজ গুলো তো ফরাসী ভাষায় করছে না – তবে কোন ভাষা? জানা গেল, ওরা ইউরোপেরই লোক – রোমানিয়া, বুলগেরিয়া থেকে এইদিকে চলে আসে, ওদের কাছে প্যারিসে থাকার কোন বৈধ কাগজপত্রও নেই। প্যারিস, লন্ডনে এসে ভিক্ষা থেকে শুরু করে, ঐ ধরণের ছিঁচকে চুরি, পকেটমারি করে দিন কাটায়, এখানে ওদের জিপসি বা রোমা বলে – গায়ের রং তো ফর্সা, তাই ভিড়ের মধ্যে ওদের উপরে পুলিশ বা সাধারণ মানুষেরও চট করে সন্দেহ হয় না, তবে ভালো করে দেখলে ওদের চামড়ার রুক্ষতা, ভাবলেশ হীন দৃঢ় মুখশ্রী, রঙচঙে চুল, কমদামী রুচিহীন পোশাক ইত্যাদি দেখে অনেকটাই বোঝা যায়, ফরাসীদের থেকে আলাদা করা যায়।
চলবে