তুলুসে এসে প্রথম মেট্রো দিয়ে যাতায়াতের সময়ে দেখতাম, জো জরাস মেট্রো ষ্টেশন থেকে প্রতিদিনই এক ভদ্রলোক কুকুর সঙ্গে নিয়ে মেট্রোয় চাপেন – ভদ্রলোককে দেখে বোঝাই যায় তিনি চোখে দেখতে পান না, কুকুরটিই তাঁকে পথ দেখায়, ভিড় ব্যস্ত মেট্রোতে চাপায়, বসার সীটের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়, ভদ্রলোক যখন সীটে বসেন – কুকুরটি নিজেই চুপচাপ সীটের নীচে বসে যায়, আশপাশের যাত্রীদের কাউকেই বিরক্ত করে না, কারোর দিকে তাকায় না, সে জানে ওর কি কাজ, আর নিজের সেই কাজেই সে মগ্ন। এতো ভদ্র, শান্ত, ভালো, শিক্ষিত কুকুর আমি আগে কখনোই দেখি নি। তারপর তো তুলুস বসবাস কালে ঐ ধরণের বহু গাইড ডগের সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছিল।
একদিন ফেরার পথে, ঐ জো জরাস মেট্রো স্টেশনেই দেখি প্রচুর গাইড ডগ ট্রেনারদের সঙ্গে ঘুরছে, আসল পরিবেশে ঐ সব গাইড ডগদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। যারা চোখে দেখতে পায় না, তাদের বন্ধু ও পথ প্রদর্শক ঐ কুকুরদের অক্লান্ত পরিশ্রম দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের ট্রেনিং দেখলাম।
কুকুর গুলোর কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, এতো মানুষের আসা যাওয়া, ভিড় ব্যস্ততা কিছুই যেন ওদের মনোযোগ ছিন্ন করতে পারছে না, এমনকি আশপাশ দিয়ে ফরাসী সুন্দরীর ছোট্ট চি উয়া উয়া বা ফরাসী পুডুল জাতীয় কুকুর চলে গেলে ফিরেও দেখছে না – এতো মনোযোগ দিয়ে ওরা পথ দেখানো শিখছে দেখে মনে হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে ওদের মনোযোগ ও দক্ষতা যেন মানুষকেও ছাড়িয়ে যায়। ভিড় বাস বা মেট্রোতে কখনোই ওদের কোন আওয়াজ করতে শুনি নি।
শুধু কি মনোযোগ, ওদের ব্যবহারেও শিক্ষার এক আভিজাত্য ফুটে ওঠে, ওদের শান্ত চোখে ঐ দৃষ্টিহীন মানুষ গুলোর জন্যে এক নীরব আশ্বাস, সহায়তা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা দেখা যায়। কুকুর হয়ে জন্মেও ওরা যেন ছোট থেকেই নিজেকে কুকুর সমাজ থেকে আলাদা করে তৈরি করে, মানুষকে সাহায্য করাই যেন ওদের জীবনের লক্ষ্য।
এক ছোট্ট বিজ্ঞাপন দেখে দৃষ্টিহীন মানুষের সর্বক্ষণের বন্ধু ঐ গাইড ডগ গুলোর কথা মনে এলো। মনে এলো, ঐ কুকুর গুলো কেমন করে নিজেদের আদিম কুকুরীয় প্রবৃত্তির বাইরে বেরিয়ে গিয়ে, বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে – যা ওদেরকে সম্পূর্ণ কুকুর সমাজ থেকে আলাদা করে দেয়, ওরাই প্রমান করে দেয়, কেন কুকুরকে মানুষের বেস্ট ফ্রেন্ড বলা হয়।