অলিভের অনেক কথা (The olive)

তুলুসে এসে আমার প্রথম পরিচয় হল অলিভের সঙ্গে। অলিভ ওয়েলের সঙ্গে তো সুপার মার্কেটের দৌলতে পরিচয় আগেই হয়েছিল, কিন্তু প্রাকৃতিক ভিটামিন ই তে পরিপূর্ণ, ঐ সর্ব গুণ সমন্বিত তেলের মূল উৎস যে ছোট্ট ছোট্ট ঐ অলিভ ফল গুলো – তা প্রথম জানলাম ফ্রান্সে এসে।

অলিভ চাষ নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী চাষ। বহু প্রাচীন কাল থেকেই ইউরোপে অলিভ চাষ হয়ে এসেছে – ও অলিভ ফল থেকে অলিভ তেল তৈরি করার পদ্ধতি প্রায় কয়েকশো বছর গ্রীকরা নিজেদের কাছেই গুপ্ত রেখেছিল ও প্রাচীন গ্রীসে অলিভ ওয়েলের খুবই ব্যবহার হোতো। গ্রীস থেকে বহু হাত ঘুরে ঘুরে ইউরোপের অন্যান্য দেশের কাছে অলিভ ওয়েল তৈরির পদ্ধতি যখন এলো, অলিভ ওয়েল প্রাচীন ইউরোপের জনজীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো।

তুলুসে এসে দেখি, আমাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে ইউনিভার্সিটির দিকে, সেই রাস্তার পাশে সারি সারি অলিভ গাছ লাগানো – গাছ গুলোকে দেখেই অনেক পুরনো বলে মনে হয় – শুনলাম আদতে গাছ গুলো পুরনোই বটে, ষাট বছরের পুরনো গাছ।

তবে, অলিভ গাছের কাছে ষাট বছর তো শৈশব দশা – গ্রীস, ইতালি, ক্রোয়েশিয়া, স্পেনে এমন অনেক অলিভ গাছ আছে, যাদের বয়স হাজার বছরের উপরে, আর সেই অলিভ গাছ গুলো আজও উন্নত মানের অলিভ ফল দিয়ে যায়, যা থেকে উন্নত মানের অলিভ ওয়েল তৈরি হয়। আর সেই হাজার দু’ হাজার বছর পুরনো অলিভ গাছের বয়সের সত্যিকারের প্রমান দেয় আধুনিক বিজ্ঞানের রেডিও কার্বনডেটিং পদ্ধতি, সত্যিই প্রমান হয়েছে কোন কোন অলিভ গাছের বয়স আড়াই হাজার বয়স!

ওজর অমর সেই গাছ গুলোও নাকি সহজে ধ্বংস হয় না, যদি মাটির উপরের অলিভ গাছ কোন কারণে মরে যায়, মাটির নীচের শিকড় থেকে নতুন গাছ সৃষ্টি হয় – যেমন ইতালিতে একবার প্রচণ্ড তুষার ও ঠাণ্ডায় চাষের অলিভ গাছ গুলো মরে গিয়েছিল, চাষিরা পথে বসার উপক্রম, কিন্তু শীত চলে গেলেই নতুন অলিভ গাছের চারা মাটি ভেদ করে উঁকি দিয়েছিল। তাই, বোধহয় ইউরোপে অলিভ গাছ প্রাচুর্য, গৌরব, শান্তি, উর্বরতা, ক্ষমতা ও বিশুদ্ধতার প্রতীক।

ইউরোপে অলিভ গাছের কাঠ থেকে শুরু করে পাতা, অলিভ শাখা, তেল সবই খুব পবিত্র বলে মানা হয়। ইউরোপের ক্যাথিড্রালের প্রদীপে অলিভ ওয়েল ব্যবহার হয়। এমনকি, অলিম্পিকের পবিত্র মশালে অলিভ ওয়েল ব্যবহার হোতো। বাইবেলেও নাকি অলিভ গাছ ও অলিভ ওয়েলের বহুবার উল্লেখ হয়েছে। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে অলিভ গাছ ও অলিভ ওয়েলের খুবই ব্যবহার হোতো। এমনকি প্রাচীন মিশরেও অলিভ ব্যবহার হোতো – তুতানখাঁমেনের সমাধিতে অলিভ গাছের শাখা পাওয়া গিয়েছিল।

এমনকি, বর্তমানে আধুনিক ইউরোপের জীবন যাপনে অলিভ ও অলিভ ওয়েল এক অপরিহার্য অঙ্গ। মেডিটেরিয়ানের যে কোন রান্না অলিভ ওয়েল ছাড়া সম্পূর্ণই হয় না।

গ্রীক রান্নার উপরে তো কয়েক পরত অলিভ ওয়েল ভাসে – আমাদের এক গ্রীক বন্ধুর নিমন্ত্রণে তার রান্নায় অলিভ ওয়েলের প্রাচুর্য দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কি সর্বদাই এমনি করে অলিভ ওয়েল খাও? সে হেসে বলল – আমার বাবার অলিভ প্লান্টেশন, বছরে গ্যালন গ্যালন অলিভ ওয়েল উৎপাদন হয়, খেতে তো হবেই। তাছাড়া, অলিভ ওয়েলে হার্ট হেলদি কলেস্টরল আছে, খাও কোন অসুবিধা হবে না।

যাইহোক, গ্রীস, ইতালি ও স্পেনে প্রচুর অলিভ চাষ হয়, ছোট্ট ফল অলিভ, ওদের অর্থনীতির এক স্তম্ভ, তাছাড়া অলিভ চাষিরা বিশ্বাস করে – সমুদ্র থেকে এক বিশেষ দূরত্বে, বিশেষ আবহাওয়ায় অলিভ গাছের চাষ ভালো হয়, উন্নত মানের তেল তৈরি হয়। আর, সেই বিশেষ দূরত্ব, ও অলিভ চাষের অনুকূল পরিবেশ গ্রীস, ইতালি ও স্পেনের মাটিতে পাওয়া যায়।

সেবার যখন স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের সেভিল শহরে যাচ্ছিলাম, পথে দিগন্ত বিস্তৃত উঁচু নিচু ঢালু মাঠে অলিভ গাছের চাষ হতে দেখেছি। ইউরোপে যত অলিভ উৎপাদন হয় তার নব্বই শতাংশ দিয়ে তেল তৈরি হয় ও বাকি দশ শতাংশ এমনি এমনি খাওয়া হয়, টেবিলে পরিবেশন করা হয়।

খাওয়ার অলিভ ফল তিন ধরণের হয় – কাঁচা সবুজ, আধপাকা হালকা লাল, ও পাকা কালো অলিভ। টেবিলে পরিবেশন করার অলিভ অলিভ গুলো খেতে খুবই ভালো – টক টক নোনতা। কিন্তু, গাছ পাড়া অলিভ খুবই তেতো, কষা, বিস্বাদ – আর সেই তেতো, কষা স্বাদ নিজে চেখে দেখে বুঝতে হয়েছে। আসলে গাছ পাড়া অলিভকে নুন জলে বিশেষ এক পদ্ধতিতে ফারমেন্ট করা হয়, তবেই ঐ টক টক নোনতা স্বাদ আসে।

ইতালি, স্পেন ও গ্রীসে পোক্ত অলিভ তোলার মরশুম যেন এক উৎসবের মতো। সেবার ইতালির তুসকানি অঞ্চল দিয়ে বাসে যাওয়ার সময় দেখেছিলাম, অলিভ চাষের বিশাল মাঠে কুশন পেতে দেওয়া হয়েছে, ও দৈত্যাকার মেশিন অলিভ গাছ গুলো ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে আর নীচের বিছানো কুশনে ঝর ঝর করে অলিভ ফল ঝরে পড়ছে।

বর্তমানে, ঐ ছোট্ট অলিভের অনেক গুণের কথা যখন পৃথিবীর মানুষ জানলো, অলিভ ও অলিভ ওয়েল শুধু গ্রীস বা ইউরোপের মাটিতেই সীমাবদ্ধ রইল না, অলিভ বিশ্ব জয় করতে বেড়িয়ে পড়ল, এখন খোলা অর্থনীতির যুগে পৃথিবীর যে কোন কোণে অলিভ ও অলিভ ওয়েল পৌঁছে যায়।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel, Western-Europe and tagged , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s