আকাশের কাছাকাছি, শূন্যের উপরে দুই বা তিন কামরার এক ঘরে, এক টুকরো আকাশ দেখে, শহরের দূষিত, বিষাক্ত হাওয়ায় বুক ভর্তি করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বসবাস করতে করতে ভাবি – এই তো আমাদের ভবিষ্যৎ, আগত কয়েক প্রজন্মের ভবিষ্যৎ দিব্যি গুছিয়ে নিলাম। আহা, কি সুন্দর কংক্রিটের দেওয়ালে দেওয়ালে ঢাকা, পরিপাটি চারিধার – তাহলে যখন একটা মানুষ এক নিঃস্ব, রিক্ত, রুক্ষ, নেড়া দ্বীপে পাগলের মতো গাছের পর গাছ লাগিয়ে দিয়ে দ্বীপটিকে এক সজীব বনভূমিতে পরিণত করে দেয়, সেখানে ফিরিয়ে আনে প্রান, আদিম সবুজ পৃথিবী – তখন তাঁকে এতো কেন সম্মান দেওয়া হয়? পদ্মশ্রী উপাধি দেওয়া হয়?
তাহলে কি মানুষের অবচেতন মনের কোথাও না কোথাও ঐ আকাশের কাছাকাছি বাসস্থানের শক্ত ভিতটিকে নড়বড়ে বলে মনে হয়? কখনো কি মনে হয় যে শিশুটি প্রজাপতির পাখার অপূর্ব রং নিজের চোখে না দেখেই বড় হচ্ছে তার জন্যে কি ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে? হয়তো মনে হয়, হয়তো আগত প্রজন্মের জন্যে রেখে যাওয়া এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ভেবে শিউড়ে ওঠে মানুষ।
তাই, যখন ব্রহ্মপুত্রের বৃহৎ নদী দ্বীপ মাজুলিতে যাদব পায়েং গাছের পর গাছ লাগিয়ে দিয়ে এক সবুজ বনভূমি তৈরি করে দেয় – তাঁকে দেওয়া হয় যথার্থ সম্মান ‘পদ্মশ্রী’।
সেই সত্তরের দশক থেকে শুরু হয়েছিল যাদব পায়েং এর গাছ লাগানোর কাজ – আর আজ তার একা হাতের তৈরি সেই ঘন বনভূমি হাতি, বাঘ, গণ্ডার, হরিণ, খরগোশ থেকে শুরু করে অন্য অনেক পাখি, প্রাণীর নিশ্চিন্ত বাসস্থান। যেখানে এক সময় কোন প্রাণী ছিল না, কোন সবুজ ছিল না, আজ সেখানে ফিরে এসেছে সবুজ, ফিরে এসেছে বহু প্রান, ফিরে এসেছে হারিয়ে যাওয়া এক আদিম পৃথিবী।
মাজুলি – যে নদী দ্বীপটি প্রতি বছর ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছিল, ধসে যাচ্ছিল, বিশেষজ্ঞের মতে আগামী পনেরো থেকে কুড়ি বছরের মধ্যে হারিয়েই যেতে বসেছিল, নদী গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছিল মাজুলির অস্ত্বিত্ব, সেই দ্বীপ যাদব পায়েং এর জন্যে ফিরে পেয়েছে নবজীবন, সবুজ বন, নতুন প্রান।
এই পৃথিবীকে তো আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাই নি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে ঋণ হিসাবে পেয়েছি, ধার নিয়েছি – আর ধার নিলে তো সর্বদাই সুদে আসলে ফিরিয়ে দিতে হয়, কিন্তু আমরা অনেকে সেই কথাটাই ভুলে গেছি। কিন্তু, কেউ কেউ মনে রেখেছে, আর তাঁরা সুদ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে পণ করে নিয়েছে। আর সারা জীবন ধরে তাঁরা সেই সুদ ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করে যায় – যাদব পায়েং তাঁদেরই এক জন।
তাঁরা পণ করে, প্রান দেব তবু প্রতিজ্ঞা রাখবো। আর তাঁদের জন্যেই এই পৃথিবীতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ বুক ভরে বিশুদ্ধ বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পারে। সেই মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধায় নিজের অজান্তেই মাথা নত হয়ে যায়। হয়তো, পৃথিবীর যে কোন বড় পুরষ্কারেই তাঁদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। আর তাঁদের মতো মানুষেরাই এই পৃথিবীকে একটি শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার এক দৃঢ় অঙ্গীকার করে।