মিউনিখ অলিম্পিক পার্কে (Olympic Park, Munich, Bavaria )

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে, মাত্র ছত্রিশ বছরের ব্যবধানে ডেমোক্র্যাটিক জার্মানির বহু প্রত্যাশিত, আকাঙ্ক্ষিত অলিম্পিক ছিল মিউনিখ অলিম্পিক। জার্মানির প্রথম অলিম্পিক জার্মানির আতঙ্ক হিটলার ও হ্যারমানের দখলে ছিল, সেই বার্লিন অলিম্পিকে নাজি জার্মানির কুখ্যাত পতাকা ও অলিম্পিকের বিখ্যাত পতাকা পাশাপাশি উড়েছে।

জার্মানির প্রথম অলিম্পিকটি পুরোপুরিই ছিল হিটলারের, তাই বার্লিন অলিম্পিকে ইহুদীদের অংশ গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। শুদ্ধ জার্মান জাতির গরিমা প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে হিটলার তখন বেছে নিয়েছিল বার্লিন অলিম্পিককে।

তারপর তো, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ইহুদীদের সঙ্গে জার্মানিতে কি ব্যবহার হয়েছে, বিশ্ব জানে। মিউনিখের কাছেই ডাহাও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এখনো তার দুঃস্বপ্নময় স্মৃতি বহন করে। যুদ্ধ শেষ, জার্মানিতে গণতন্ত্র স্থাপিত হয়েছে, এবার মিউনিখ অলিম্পিকে জার্মানির কাছে সুযোগ এসেছে জার্মানির সঠিক গণতন্ত্রের রূপ প্রকাশের। তাই মিউনিখ অলিম্পিক জার্মানির বহু স্বপ্নের অলিম্পিক, বিশ্বের সামনে নিজেদের উদারতা দেখানোর এক সুযোগ।

কিন্তু, ছত্রিশ বছর সময় তো খুব একটা দীর্ঘ সময় নয়, তখনো জার্মানির মানুষের মনে ও ইহুদীদের মনে যুদ্ধের কতো ঘা দগদগে, বহু আঘাতে এখনো রক্ত ঝরে, তবুও সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহন করতে এসেছিল ইস্রায়েলের খেলোয়াড়রা।

যুদ্ধের পরে জার্মানিতে প্রথম এই মিউনিখ অলিম্পিকের এক অন্য গুরুত্বও ছিল – এই অলিম্পিকে ইজ্রায়েলের অংশগ্রহণ, যে ইহুদীরা জার্মানি ছেড়ে গিয়েছিল আবার তারা খেলার জন্যে ফিরছে তাঁদের মাতৃভূমিতে, সেই ক্ষেত্রে জার্মানি ও ইজ্রায়েলের কাছে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণ এক আবেগঘন সময় বলা যায়। মিউনিখও বন্ধুত্বের উদার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সামারের এক উজ্জ্বল সকালে ডাহাও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে হাজার মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে বহু সমারোহে শুরু হয়েছিল মিউনিখের অলিম্পিক উৎসব।

অলিম্পিকের বাজনার সুরে, খেলোয়াড়দের জেতার আনন্দে, দর্শকদের উল্লসিত চিৎকারে যুদ্ধের স্মৃতি সম্পূর্ণ ঝাপসাই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, নতুন রূপে ফিরে এলো হিটলারের আত্মা, মিউনিখ অলিম্পিক গ্রামে ফিরে এলো সন্ত্রাসবাদীদের আতঙ্ক। ইস্রায়েলের খেলোয়াড়দের বন্দী করে নিল ও দু’জনকে প্রথমেই মেরে ফেলল  প্যলেস্তাইনের সন্ত্রাসবাদী দল – ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর দল। আবার ইহুদি রক্ত ঝরল জার্মানির মাটিতে।

নিজেদের স্বাধীন উদারতা প্রকাশের জন্যে সেবার মিউনিখ অলিম্পিক গ্রামের পাহারা ও সুরক্ষা ব্যবস্থায় খুবই ছাড় দিয়েছিল বেভেরিয়ান পুলিশ –  শুধু কিছু আসল পুলিশদের কোন আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াই সাদা পোশাকে পাহারার ব্যবস্থা করেছিল। এমনকি, অলিম্পিক গ্রামে খেলোয়াড়দের থাকার জায়গায় কোথাও কোন পাহারাদার বা সুরক্ষা ছিল না, খেলোয়াড়দের থাকার জায়গায় সবারই অবাধ যাতায়াত ছিল, আর সেই উদারতারই সুযোগ নিয়েছিল সন্ত্রাসবাদীরা। এমনকি, শোণা যায় ওরা আগের দিন অলিম্পিক গ্রামে গিয়ে ইস্রায়েলি খেলোয়াড়দের থাকার জায়গা দেখে এসেছিল।

তারপর তো ইস্রাইয়েলের বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার জন্যে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে মিউনিখ পুলিশ ও কর্তৃপক্ষ প্রচুর আলোচনা করল, কথা বলল, কিন্তু, শেষ রক্ষা হল না। সমস্ত খেলোয়াড় ইস্রায়েলি বন্দীদের নির্মম ভাবে হত্যা করল সন্ত্রাসবাদীরা। সন্ত্রাসের সামনে সেই আবার জার্মানির হার হল। বিশ্বের কাছে, বিংশতম অলিম্পিকের ইতিহাসে এই বেদনাদায়ক, নির্মম ঘটনা ‘Munich massacre’ নামে কলঙ্কিত হয়ে গেল। মিউনিখে বিংশতম অলিম্পিকের ইতিহাস ইস্রায়েলের মানুষের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে রইল।

সন্ধ্যার মুখে মিউনিখের নির্জন অন্ধকার অলিম্পিক পার্কে পৌঁছে বাহাত্তরের সেপ্টেম্বরের সেই আতঙ্কের আভাস পাওয়া যায় না ঠিকই, তবে অদ্ভুত নির্জনতা, অন্ধকার, শীতলতা ঘেরা অলিম্পিক পার্কের পথে  সেই আতঙ্কের দমবন্ধ করা হাওয়া বা দীর্ঘশ্বাস যেন এখনো থমকে আছে কোন এক অন্ধকার কোণে।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, Germany, Travel, Western-Europe and tagged , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান