যাইহোক, হঠাৎ দেখি দু’জন যুবক ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। উত্তর ইউরোপের এই দেশে এসে, ইংরেজি শোণাটা অনেকটা ঠিক মাতৃভাষা শোণার মতোই মনে হয়। তাড়াতাড়ি ওদের ডেকে তালিন বাস স্টপের রাস্তা জিজ্ঞেস করলাম। ওরাও এই দেশে নতুন – ব্রিটেন থেকে বন্ধুর কাছে বেড়াতে এসেছে। আমাদের হাতের ম্যাপটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভালো করে দেখে, আবছা ভাবে এক সোজা রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলল – ঐ দিকে এগিয়ে গিয়ে, আরও কাউকে জিজ্ঞেস করে নিও। তালিনের বাস স্টপ কোথায় ওরা ঠিক জানে না। ওরা এগিয়ে গেলো – অন্য দিকের এক রাস্তা ধরে।
ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বাঁ দিকে একে একে বিশাল কেল্লা, ঐতিহাসিক তালিন শহরকেন্দ্র, পার্ক, বিশাল বিল্ডিং সবই পেড়িয়ে চলেছি। এক রাস্তার মোড়ে এসে তালিনের বিশাল এক ম্যাপ দেখে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে দেখে নিলাম – হ্যাঁ এতক্ষণ তো ঠিক দিকেই চলেছি। তবে কাউকে জিজ্ঞেস করে নিলে আরও ভালো হয়, ভাবতে ভাবতে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে বিল্ডিং ও এক সুপারমার্কেটের তুলনামূলক ভিড় ও ব্যস্ত গলির সামনে এসে এক পুলিশের দেখা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম – এখান থেকে Tallinna bussijaam কি ভাবে যাবো।
পুলিশও রাশিয়ান ও ইস্তনিয়ান ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা পারে না, তবে বিদেশী দেখে সাহায্য করার জন্যে যেন উন্মুখ হয়ে আছে। এই যে এতো দূর থেকে ওদের দেশ দেখতে কেউ এসে, ওকে জিজ্ঞেস করছে রাস্তা কোন দিকে, তাও আবার ম্যাপ দেখিয়ে – কি যে খুশী পৌঢ় পুলিশটি। যেন এতদিনের চাকরির সবচেয়ে সুখের কাজটি আজই করছে। কিংবা আজই হয়তো জানল ওর অতি পরিচিত এই জায়গার এক ম্যাপও আছে – কে জানে।
আমাদের সঙ্গে একটা গলির মুখে অনেকটাই হেঁটে এসে, এক সোজা রাস্তা ও এক বিল্ডিঙের চূড়া দেখিয়ে দিয়ে – আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বলল, ঐ বড় বিল্ডিঙের ওপাশেই bussijaam। কিছুদূর হাঁটতেই, ফাঁকা রাস্তার মোড়ে দেখি সেই দুই ব্রিটিশ যুবক হেঁটে আসছে, আমাদের দেখে পরিচিতির হাসি হেসে বলল – বাস স্টপের রাস্তা খুঁজে পেয়েছ? আমরা বললাম – মনে হয়, পুলিশ তো বলল, সামনের ঐ বিল্ডিঙের ওপাশেই। ওরাও জেনে নিল। রাস্তা যে সবই গোলকধাঁধা ময়!
কিছুটা হেঁটে দূরে bussijaam এর বিশাল বিল্ডিং নজরে পড়ার পরে আশ্বস্ত হলাম। হাতে তখনও দশ মিনিট আছে। তালিন বাস স্টপে ঢোকার মুখে পুরনো দিনের এক বাস দাঁড়িয়ে আছে – তালিন থেকে লেনিনগ্রাদ যাওয়ার বাস।
লেনিনগ্রাদের নাম বদলে গেছে- কিন্তু, সেই সময়ের এই বাসটি এখনো লেনিনগ্রাদের স্মৃতি বহন করছে। লেনিনগ্রাদের বাসটি দেখে হঠাৎ-ই আবছা মনে এলো – ছেলেবেলার কথা, বাড়ীতে তখন চকচকে পাতার এক মাসিক পত্রিকা আসতো ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ – অপেক্ষায় থাকতাম।
পাতায় পাতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের রঙিন ছবি, ছোটদের গল্প আর রাশিয়ান শেখানোর জন্যে এক পাতা। সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক আকর্ষণ ছিল – চকচকে বিশাল পাতা গুলো দিয়ে চমৎকার বই মলাট দেওয়া যেতো। রাশিয়া তো আর যাওয়া হল না, তবে রাশিয়ার হাওয়া, জল, মাটি ছুঁয়ে আসা বাসটিকে একটু ছুঁয়ে রাশিয়া যাওয়ার স্বাদ মিটিয়ে নিলাম। জানি ছেলেমানুষী, তবুও বাসটির ঠাণ্ডা শরীরে একটু হাত বুলিয়ে দিলাম।
ঠিক সময়েই পৌঁছে গেলাম বাসের সামনে, একে একে পাসপোর্ট দেখে দেখে যাত্রীদের সবাইকে বাসে ওঠাচ্ছে। সঠিক সময়ে আধো আঁধারের বুক চিরে আমাদের হলুদ বাসটি এক দেশ থেকে আরেক দেশের দিকে দুরন্ত গতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে, পেড়িয়ে চলেছে কতো গ্রাম, কতো শহর, কতো জঙ্গল, মাঠ ঘাট। শুধু পেছনে পড়ে রইল আমাদের উৎকণ্ঠাময় তালিন বিকেলের এক টুকরো স্মৃতি চিহ্ন।