এস্কুইরলের বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় প্রায়ই কানে আসে ভায়োলিনের মন ভোলানো এক সুর। বুঝি ক্যাপিটলের দিকে যাওয়ার রাস্তার মোড়ে বয়স্ক ভিখারিটি বাজাচ্ছে। তার বাজানো সুরে কখনোই ক্ষুধার্ত মনখারাপের সুর শোণা যায় না, শীতের বিষণ্ণ ধূসর বিকেলে বা মেঘলা বৃষ্টি ভেজা দিনে ওর প্রান কাড়া সুর শুনে অনেকেরই মন ভালো হয়ে যায় – ওর সামনে রাখা টুপিতে সেই ভালো লাগার উপহার জমা পড়ে – দশ, কুড়ি সেন্ট, এক ইউরো। ব্যস্ত জায়গাটাকে ও সুরে মাতিয়ে রাখে, পুরো জায়গাটা গমগম করে।
আবার ডিসেম্বরে যখন দোকানে দোকানে ক্রিসমাসের জন্যে সবে আলো সাজানো শুরু হয়, ক্যপিটলের মোড়ে বা ব্যস্ত গলিতে গিটার বাজিয়ে আফ্রিকান ভিখারিটির গাওয়া ক্রিসমাস ক্যারলেই ক্রিসমাসের এক মেজাজ তৈরি হয়, মন ভালো হয়।
ইউরোপে যেখানেই গেছি ভিখারির দেখা পেয়েছি, ইউরোপের প্রত্যেক দেশের ভিখারিদের ভিক্ষা করার পদ্ধতি আলাদা, অভিনব। তবে, বেশীরভাগ দেশে ভিখারিরা রাস্তার মোড়ে নিজেদের বাজানো বাজনার সুর শুনিয়েই ভিক্ষা করে – ওরা নিজেদের ‘Buskers’ বলে, কোথাও কোথাও আবার শুধুই ভিক্ষা করতে দেখেছি। ফিনল্যান্ড, সুইডেনের ভিখারিরা রাস্তার মোড়ে সাষ্টাঙ্গ প্রনামের ভঙ্গি করে, মুখ ঢেকে ভিক্ষা করে।
মুখ না দেখিয়ে ভিক্ষা করার আরেক অভিনব পদ্ধতি স্পেন, পর্তুগাল, ইতালির শহর গুলোয় দেখেছি। রোমে এসে রাস্তার ধারে তুতানখামেনের সোনালি মূর্তি দেখে অনেক জাপানি টুরিস্ট যখন মূর্তিটির সঙ্গে ফটো নিতে পাশে দাঁড়ায়, মূর্তিটি নড়ে ওঠে পাশে রাখা ভিক্ষার থলি দেখিয়ে দেয়। মূর্তির মুখের রং চঙ্গের পেছনে আসল মুখের রং কি – সে দেখা যায় না। হেলসিঙ্কির এক পার্কে বসে এমনি এক ভিখারিকে চোখের সামনে ধড়া চূড়া পড়ে স্পাইডার ম্যান সাজতে দেখেছিলাম আর ঠিক সেই সময় একদল পুলিশ চলে এসেছিল – চোখের সামনে স্পাইডার ম্যানকে পুলিশের ভয়ে পালাতে দেখেছিলাম।
আবার কোথাও ভদ্র ভাবে এসে বিয়ার খাওয়ার পয়সা চায়। ভিলিনুসে তেমনি এক ভিখারির দল এসে জানতে চাইল – কোন দেশ থেকে এসেছ? তোমাদের দেশে তো গরীবদের খুব দয়া করে, আমাকে চার ইউরো দাও দেখি, গলা শুকিয়ে গেছে, বিয়ার খাবো।
জাগ্রেব ক্যাথিড্রালের সামনের চত্বরে বসে লোক জনের আনাগোনা দেখছি – এক মধ্য বয়সী ক্রয়েশিয়ান লোক এসে পাশে বসে জানতে চাইল – কোন দেশ? আরে আমিও তো ঐ দেশের, আমার ফোর, ফোর, ফোর, ফোর ফাদার ঐ দেশ থেকেই এসেছিল। আমি বললাম – থাক আর পেছনে যেতে হবে না। কি চাই। হেসে লোকটি বলল – পাঁচ ইউরো দাও। আমি ভালো করে লোকটার পরনে ভদ্র গোছের কালো কোট প্যান্টের দিকে তাকালে, ও যেন বুঝতে পারল, বলল – এই কাপড় তো আমাকে দিয়েছে, মরা মানুষের কাপড়। আর আমার গায়ের রং এমনিতেই ফর্সা। যেন ভিক্ষা করতে গেলে গায়ের রং কালো হওয়া যোগ্যতার মাপকাঠি।
মিউনিখ, প্যারিস, প্রাগ, ভিয়েনার ভিখারিরা তো আবার রাস্তার মোড়ে, পার্কে – মোজার্ট, বাখ, বেঠোফেনের স্বরলিপি সামনে নিয়ে সুর বাজিয়ে বাস্কিং করে। জেনেভার ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে কোন এক বাস্কারের বাজানো আশ্চর্য সুর শুনে থমকে দাঁড়িয়ে শুনতে হয়েছে, ভাবতে চেষ্টা করেছি আগে কোথায় শুনেছি এই সুর। অবশ্য, রাস্তার পাশে বাজনা বাজিয়ে, গান গেয়ে পয়সা চাওয়াটাকে ওরা ঠিক ভিক্ষার পর্যায়ে ফেলে না, কারণ যে সুর ওরা বাজায়, যে কোন রেকর্ড শুনতে গেলেও তো পয়সা দিয়ে কিনে শুনতে হয়। আর ওদের বাজানো সুর তো ইউরোপের প্রাচীন শহর গুলোয় এক নস্টালজিক, সঙ্গীতময়, রোম্যান্টিক পরিবেশ তৈরি করে, এ যে ওদের সংস্কৃতি ও পর্যটনের অঙ্গ। তাছাড়া, গান বাজনা বাজিয়ে শহরের মাঝে বাস্কিং করতে গেলে পুলিশের কাছ থেকে অনুমতিও নিতে হয়, না হলে পদে পদে পুলিশের তাড়া খাওয়ার ভয় থাকেই।
ইউরোপে অনেক ভিখারিকে দেখেছি নিজেদের সঙ্গে বড় বড় কুকুর রাখতে। কুকুর রাখার কারণ পরে জেনেছি – এখানে অনেকেই পশু পাখিদের দয়া করে, আর সেই দয়ায় ভিক্ষাও দেয়, আর কুকুর পোষার জন্যে কিছু সরকারী অনুমোদনও পায়। আর খুব ঠাণ্ডায় কুণ্ডলীকৃত কুকুরের পাশে বসলে ভিখারি ও কুকুর দু’জনেরই ঠাণ্ডা কম লাগে, তাছাড়া একই স্লিপিং ব্যাগে কুকুরকে জড়িয়ে ঘুমোলে ঠাণ্ডার তীব্রতা একটু কম মনে হয়। শীতকালে সারা ইউরোপে অনেক ভিখারিই অত্যাধিক শীতে জমে গিয়ে মারা যায়। যদিও ভিখারিদের থাকার জায়গা করে দেয় স্থানীয় সরকার, কিন্তু অনেকেই সেখানে জায়গা পায় না। শীতের সকালে মাঝে মাঝেই পুলিশ, ইউরোপের রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিখারিদের তুষারাবৃত মৃতদেহ আবিষ্কার করে।
এখানে অনেক ভিখারি আবার সুন্দর বিড়ালও রাখে, সাদা সুন্দর বেড়াল দেখে ফ্রান্সে অনেক বয়স্ক মহিলাই “ত্রে মিনিও” বলে বেড়ালের গায়ে একটু হাত দিতে চায়। আর এখানে বেড়ালের গায়ে হাত দিতেও ইউরো দিয়ে তবে হাত দিতে হয়।
এস্কুইরলের মোড়ে এক ভিখারি দু’টো কুকুর আর একটা খুব সুন্দর সাদা বেড়াল নিয়ে বসে। প্রায়ই দেখি সাদা বেড়ালের গায়ে হাত দিতে মহিলারা একটু থামে, পার্স খুলে খুচরো দিয়ে তবে বেড়ালকে কোলে নেয়। আমাদের দেশে কল্পনা করা যায়! শহরের ভিড়ের মধ্যে, হাজার মানুষের আনাগোনার মধ্যে এক বেড়াল শান্ত হয়ে বসে আছে, আর যে কোন মানুষের কোলে চলে যাচ্ছে? শীতে বৃষ্টিতে নিজে ও কুকুর দু’টো ভিজলেও ভিখারিটি কখনোই ওর বেড়ালকে ভিজতে দেয় না। অনেক বারই দেখেছি ছাতা মাথায় নিয়ে, বেড়াল ঘাড়ে করে ভিক্ষা করছে।
আরেক বয়স্ক ভিখারি ক্যাপিটলে রবিবারের বাজারে ধবধবে সাদা মোটা এক বেড়াল নিয়ে বাস্কিং করতে আসে। ভিড় বাজারের মাঝে অতি প্রাচীন এক বাদ্য যন্ত্র বাজায়, আর বেড়ালটি পাশে শুয়ে টেনে ঘুম দেয় – বাজারের কোলাহল, ভিড়, মানুষের আনাগোনায় ওর কোন মোহ নেই, মনোযোগ নেই। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেড়ালটি শুধু বাজার শেষের অপেক্ষা করে।
ভিক্ষা করেও ইউরোপের ভিখারিদের আত্ম সম্মান জ্ঞ্যান আবার খুব বেশী। বিদেশী হয়ে ওদের দেশের ভিখারির ফটো তুলে নেওয়া বেশ বিপজ্জনক হতে পারে কখনো কখনো। আমার জানা শোণা এক ভদ্রলোক ইউরোপের রাস্তায় যেখানেই ভিখারি দেখতেন ফটো তুলে নিতেন, একদিন এক ভিখারি রীতিমত তেড়ে এসে ক্যামেরা প্রায় কেড়েই নিচ্ছিল আর কি। ভিখারিটির ফটো ডিলিট করে তবে রেহাই পেলেন তিনি।