প্রতিযোগিতা (Fiction)

ঈশ্বরের কি কারোর সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল? আজকাল মিঠু প্রায়ই এই কথাটা ভাবে। প্রতিযোগিতা থাকলে কি ঈশ্বর এত সুন্দর পৃথিবীর সৃষ্টি করতে পারতেন? সুন্দর প্রজাপতি, ঝরনা, বৃষ্টি, মৌমাছি, ফুল, নদী ?

আজ ওর স্কুলের রেজাল্ট বেরোবে। সকাল থেকে তাই মিঠুর মন দুরুদুরু। অথচ আজ সকালটা এত সুন্দর ছিল। নীল আকাশ। ফুটফুটে রোদ। মৃদু হাওয়া। পাখির কলকাকলি। মিঠুর মনে হচ্ছিল বেরিয়ে যায় সাইকেলটা নিয়ে এদিকে সেদিকে যেদিকে ইচ্ছে। অথচ রেজাল্টের চিন্তাটা মিঠুর আজকের দিনের সুর তাল কেটে দিল। যাইহোক, মিঠু সকালে স্নান করে খেয়ে গুটিগুটি পায়ে স্কুলের উদ্দেশে রওনা দিল।

স্কুল মিঠুর বাড়ির খুব কাছেই, হেঁটেই যাওয়া যায়। রেজাল্ট মিঠু তাই নিজেই আনতে যায়। বাবা-মা দু’জনেই বড় ব্যস্ত। দু’জনেই ডাক্তার। ওদের নিজস্ব চেম্বার, হাসপাতাল, পার্টি ইত্যাদি নিয়ে দারুন ব্যস্ততায় দিন কাটে। শুধু রেজাল্টের সময় দু’জনেই খুব ব্যস্ত হয়ে যান রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে। মিঠুর রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে ক্রমাগত বলে যাবেন টিয়া, সঙ্গীতা ওরা কোন বিষয়ে কত মার্কস পেল- অঙ্কে, বিজ্ঞানে, ইংলিশে।

আসলে টিয়া, বাবার হাসপাতালের মেট্রনের মেয়ে। টিয়া খুব ভালো মেয়ে, খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে, গান গায়, স্কুলের সব অনুষ্ঠানে ও না থাকলে চলে না। স্কুলের নাটকে ওর অভিনয় দেখার মত। টিয়া মিঠু দু’জনের দারুন বন্ধুত্ব।

মিঠুও ভালো নাচত, গান গাইতো, ছবি আঁকত। কিন্তু, পড়াশোনার জন্য বাবা সব কিছু ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে দিলেন। ছবি আঁকার হাত মিঠুর বেশ ভালই ছিল। রঙের ব্যবহার মিঠু এত ভালো করতে পারত, যে আঁকার দিদি ক্লাসের সবাইকে বলতেন- “যাও মিঠুর ছবিতে রং-এর ব্যবহার দেখে এস”। মিঠুর ছবিতে আকাশের অস্ত গামী সুর্যের অদ্ভুত রঙের খেলা দেখে তিনি বলতেন “বাঃ”। মিঠুর প্রশংসা শুনতে ভালো লাগত। মিঠু মনের আনন্দে আঁকত। ওর আঁকা তিনটে ছবি স্কুলে সবচেয়ে ভালো ছবির বিভাগে রাখা হয়েছে। মিঠু তো আনন্দে আত্মহারা।

বাড়িতে বলতেই বাবা বলে উঠলেন, “ছবি আঁকা! এটা আমাদের কাজ নয়- তাছাড়া তুমি কি এত ভালো আঁকতে পার? মনিষ কে দেখো কত ভালো ছবি আঁকে। ওর মত কি তুমি পারবে?” মিঠু মুখ নিচু করে শুনে গেল। কিছু বলল না। তবে বাবার এই কথা কাজে লাগলো, মিঠু ছবি আঁকা ছেড়ে দিল। বাবা- মা জানতেও পারলেন না, বা জানার বৃথা চেষ্টাও করলেন না। ওদের অনেক কাজ আছে। মিঠুর মনের খবর নেবার সময়ই নেই।

স্কুলে বন্ধুরা সবাই বলল, “তুই আজকাল আঁকিস না? ছেড়ে দিয়েছিস? মিঠু মাথা নাড়ে “হুম”। যাই হোক, মিঠু ভাবে সৃষ্টি, আঁকা, এই সব মনের ব্যাপার। মন যখন সায় দেয় না তখন ঐসব হবে না। কোনো সৃষ্টি কি আর প্রতিযোগিতায় নামতে পারে? ধীরে ধীরে মিঠুর আঁকার সত্তা মরে যায়।

স্কুলে এসে ক্লাসের সবাইকে দেখতে পেল। মিঠু ওদের দিকে এগিয়ে গেল। অনেকের মা বাবা এসেছেন। টিয়াকে দেখতে পেয়ে ও টিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। টিয়া মিঠুর দিকে সংশয় পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কি রে ভয় লাগছে? দেখ আমার হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে।” মিঠু টিয়াকে স্পর্শ করে দেখল সত্যি তাই, মিঠু মাথা নাড়ল, বলল “আমারও রে”।

একটু পরে হইচই এর মধ্যে রেজাল্ট বেরোল। টিয়া দিব্তীয় হয়েছে, মিঠু তৃতীয়।

মিঠুর অঙ্ক খুব একটা ভালো হয়নি, পঁচাশি। তা হোক, মিঠু খুব খুশি, কারণ গত বছর মিঠু প্রথম দশ জনের মধ্যে ছিল না। এবার এইট থেকে নাইনে ওঠার পরীক্ষার জন্য মিঠু খুব পড়াশোনা করেছে। আসলে ওর পড়াশোনা করতে বেশ ভালো লাগছে, গত কয়েক মাস ধরে। পড়াশোনার মধ্যে নিজের একটা জগত খুঁজে পেয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল যে নিজের জগত তৈরী করার জন্য পড়াশোনা করা খুব দরকার।

ক্লাসের বইয়ের বাইরেও মিঠু অনান্য বই খুব পড়ে, বাবা মা কে লুকিয়ে, স্কুলের লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে। বাবা মা জানলে এতেও হয়তো বাধা পড়ত। বেশ কয়েকটা ক্লাসিক ওর পড়া হয়ে গেছে- শার্লক হোমস ওর প্রিয়, বুদ্ধিতে ও মিস মার্পেল এর মত হতে চায়, প্রফেসর শঙ্কু ওর প্রিয় বিজ্ঞানী। হারি পটার, কিরিটি, ব্যোমকেশ বকশি, ফেলুদা, টেনিদা এদের সঙ্গেও ওর পরিচয় হয়েছে।

মিঠুদের বাড়িটা খুব সুন্দর। সামনে সুন্দর বাগান। বাড়ির বাইরে কিছু দুর থেকে শুরু হয়েছে ঢালু চা বাগান অঞ্চল। দূরে দেখা যায় নীল পাহাড়ের সারি। ভোর বেলা যখন কুয়াশায় ঢেকে যায় তখন কি যে সুন্দর এবং রহস্যময় লাগে মিঠুর। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দৃশ্যপট বদলে যায়- সকাল থেকে বিকেলে সূর্যের আলোর খেলায় নীল পাহাড়ে অদ্ভুত মায়াবী ছবির সৃষ্টি হয়। মিঠু অবিভূত হয়। মিঠুর বাবা অরুনাচলপ্রদেশের এই জায়গায় বাড়ি করেছেন বলে বাবাকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয়।

বিকেল থেকেই আজ মিঠু ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছে বাবা-মা-এর জন্য। এসেই তো হাঁক পাড়বেন- কি মিঠু রেজাল্ট কোথায়? কেমন হলো, অন্যদের কেমন হলো ইত্যাদি। বাবা-মা দু’জনেই একসঙ্গে ফেরেন চেম্বার থেকে। ওদের পাশাপাশি চেম্বার। আজ যেন একটু বেশি রাত হচ্ছে ফিরতে। মিঠু তো ঘুমিয়েই গেছিল। গাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। বাবার ডাক শোনা গেল- “মিঠু রিপোর্ট কার্ড কোথায়? কেমন হলো? দেখাও।” মিঠু রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে পায়ে পায়ে  এগিয়ে গেল। রিপোর্ট কার্ড-এ চোখ রাখার আগেই বাবার প্রশ্ন, “টিয়ার রেজাল্ট কেমন হলো?”

“সেকেন্ড।” মিঠু উত্তর দিল।

“তোমার?”- মা’র প্রশ্ন।

“থার্ড।” মিঠু নত মুখে উত্তর দিল।

ও জানে এখন শুরু হবে বাক্যবান; টিয়ার কি কি ভালো, কতক্ষণ পড়াশোনা করে, তুমি টিয়ার মত হতে পার না? আরো কত কি; যা যা ভেবেছিল বাবা মা মিলে মিশে তাই বলে গেলেন। মিঠু চুপচাপ শুনলো।

মিঠু মনে মনে ভাবে- আচ্ছা ওরা এটা কেন বোঝেন না, যে গতবারে প্রথম দশ জনের মধ্যেও ছিল না, এইবার সে প্রথম তিনজনের মধ্যে নিজেকে নিয়ে এসেছে। এটা কি যথেষ্ট নয়? তার মানে এইবার সে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছে। অনেক আদাজল খেয়ে পড়াশোনা করেছে। এই যে আজ ও তৃতীয় হয়েছে সেটা যে ওদের চাপে তা কিন্তু নয়। মিঠু পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়- তাই তো মিঠু পড়েছে। ভালোবেসে পড়েছে। ও বুঝেছে পড়াশোনা করেই আলোর দরজা খুলে যায়- তাই ও পড়েছে। কাউকে হারানোর জন্য বা প্রতিযোগিতায় নিজেকে আগে রাখার জন্য ও পড়েনি, কারণ মিঠু প্রতিযোগিতার কথা ভাবলেই কেমন যেন ভয় পায়, নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ভাবে ও আমার কাজ নয়।

ঈশ্বরের তো কারোর সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। তবু তো কত সুন্দর পৃথিবী গড়েছেন। তবে আমরা মানুষেরা নিজেদের পৃথিবী তৈরী করার জন্য কেন প্রতিযোগিতায় নামব? আমি কি আমার মত করে নিজের কাজ করতে পারি না? ওদের যা ভালো লাগে তা আমার কেন ভালো লাগবে? আমার যা ভালো লাগে তা ওদের ভালো নাও লাগতে পারে- এইসব নানান ভাবনা মিঠু কে ঘিরে রাখে।

ক্লাস নাইনে বন্ধুদের মনোভাবে দারুন এক পরিবর্তন দেখা গেল। মিঠু দেখে ক্লাসের সবাই একটু গম্ভীর। পড়াশোনাতে একটু বেশি মনোযোগী। টিয়া তো শুরু থেকেই দারুন ভাবে পড়াশোনা করতে শুরু করেছে। বলছে- “বুঝলি মিঠু সামনে মাধ্যমিক আমাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবেই। কারণ আমার তো বাবা নেই। ভালো রেজাল্ট না করলে, ভালো চাকরি না পেলে, মাকে কে দেখবে রে? আমি ছাড়া তো মা’য়ের কেউ নেই।” টিয়ার কথা শুনে মিঠুর কষ্ট হয়।

মিঠুর উপরেও পড়াশোনার দারুন চাপ বাড়ছে। আসলে মিঠুর তো চাপ বলে মনেও হয় না। কিন্তু বাড়িতে যা শুরু হয়েছে- সমস্ত বিষয়ে টিউটর রাখা হয়েছে। এমনকি সংস্কৃতের ও টিউটর আসছেন বাড়িতে। সবাই নিজের সময় মত বাড়িতে এসে পড়িয়ে দিয়ে যান মিঠুকে। যেমন করে হোক মিঠুর ভালো রেজাল্ট হওয়া চাই।

স্কুলেও মিঠু, টিয়া- মানে প্রথম তিনজনের উপরে সিস্টারদের দারুন আশা, কারণ মিঠুদের স্কুল অরুনাচলের এক নামী স্কুল এবং প্রতিবছর বোর্ড এর প্রথম তিনজনের মধ্যে ওদের স্কুলের প্রথম ছাত্র বা ছাত্রী স্থান পায়।

নাইন থেকে টেন এর পরীক্ষাতে মিঠু প্রথম হলো। সবাই খুব খুশি। বিশেষ করে মিঠুর বাবা-মা। আত্মীয় স্বজনের সামনে ওদের গর্বে বুক ফুলে গেল। মিঠুর মা বিরাট পার্টির ব্যবস্থা করে ফেললেন, মানে মা’য়ের বন্ধুমহলে মেয়ের সাফল্যের খবর জানিয়ে দেওয়া, আর কি। মিঠুর স্কুলের বন্ধুরা, টিয়া, টিয়ার মা সবাই নিমন্ত্রিত ছিলেন। সব মিলিয়ে এক বিরাট হইচই ব্যপার, মিঠু ও খুব খুশি।

ক্লাস টেন-এ তো এক ভীষন গুরুগম্ভীর আবহাওয়া। সর্বদা কোনো না কোনো শিক্ষক বা শিক্ষিকা ওদের মাধ্যমিকের কথা মনে করিয়ে দিয়ে নানান রকম উপদেশ দিতে শুরু করেছেন। বাড়িতেও মা বাবা আর টিউটরদের উপদেশ। এইগুলো যেন এক নিত্য রুটিনের মত হয়ে গেল। প্রায় সবাই মিঠু কে বলতে থাকেন, তুমি প্রথম ছাত্রী, তোমাকে সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে, মিঠুর ধীরে ধীরে যেন এক মানসিক পরিবর্তন আসে। ছোট থেকে যে জিনিস এড়িয়ে এসেছে “প্রতিযোগিতা”, তাই আজ যেন ওকে ধীরে ধীরে  গ্রাস করে ফেলে –“হুম, আমাকে সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতেই হবে, আমাকে অনেক পড়তে হবে, দৌড়তে হবে, এগোতেই হবে।” মিঠু ভাবে। শুরু হয় পড়া পড়া আর পড়া, পড়ার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় মিঠু। ভাবে- জিততেই হবে।

আজ আর মিঠুর নীল পাহাড়ের রংবদল দেখার সময় নেই। সামনের বাগানে কি ফুল ফুটল, কোন নতুন প্রজাপতি এল সেটা দেখারও  সময় নেই, সুন্দর দিন অনুভব করার  সময় নেই।

অঙ্ক, বিজ্ঞান, ভূগোল- মানে মাধ্যমিকে যা যা বিষয় তাই মিঠুর জীবন হয়ে উঠলো। রাত জেগে জেগে পড়া, সারা দিন পড়া- এই মিঠুর জীবন এখন। বাবা-মা দারুন খুশি। সবাইকে বলেন- আমার মেয়ে তো খুব পড়াশোনা করছে। আশা করা যায় বোর্ডের প্রথম তিনজনের মধ্যে ওর স্থান হবে।

মিঠুর এখন কোনো কথাতে কান দেওয়ার সময় নেই। মাথার মধ্যে সর্বদা টিক টিক করে- এগোতে হবে, এগোতে হবে। কেমন যেন এক অস্থিরতা মনের মধ্যে। এখন ও টিয়া কেও হিংসা করতে শুরু করেছে। যে কিনা ওর প্রানের বন্ধু ছিল আজ ও তাকে হিংসা করছে? মাঝে মাঝে মিঠু শিউরে উঠে নিজের মনের এই পরিবর্তনের দিকে তাকালে, ভাবে- আমার কি হলো।

কত দিন হয়ে গেল মিঠু প্রাণ খুলে হাসেনি। টিয়ার সঙ্গে গল্প করেনি। বৃষ্টি দেখেনি। মনে শান্তি পায়নি। কেন এমন হলো- মাঝে মাঝে মিঠু গুমড়ে ওঠে।

যাইহোক, পরীক্ষা তো একেবারে দোরগোড়ায়। মিঠুর দিনে রাতে তাই পড়াশোনার হার আরো বেড়ে যায়।

আজ মাধ্যমিকের প্রথম দিন। অঙ্ক পরীক্ষা প্রথম দিনে। মিঠুর পরীক্ষা মোটামুটি হলো- মানে মিঠুর মনের মত হলো না। দুই মার্কের একটা ছোট অঙ্ক ছেড়ে দিতে হলো। মিঠুর দারুন চিন্তা হতে শুরু হলো ওই ছেড়ে যাওয়া দুই মার্কস নিয়ে। মা যদি জানেন তাহলে আর রক্ষা নেই। হাজার প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলবেন। মিঠুর অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা হতে সুরু হলো। ফিরে এসে কিছু না খেয়েই পরের দিনের পরীক্ষার জন্য পড়তে বসে গেল, কিন্তু মাথায় ঘুরতে লাগলো ওই ছেড়ে যাওয়া দুই মার্কস। নিজেকে সান্ত্বনা দিল, এইবারের পরীক্ষাতে যাতে এক মার্কসও হাতছাড়া না হয়।

মিঠুকে সমস্ত কিছু একবার রিভিসন দিতে হবে। ও লেগে পড়ল। কাজের মাসি দু’বার খাবার নিয়ে ঘুরে গেল কিন্তু মিঠুকে খাবার খেতে বলার সাহস পেল না, কারণ মায়ের কড়া নির্দেশ আছে, যে যখন মিঠু নিজের রুমে পড়াশোনা করবে, তখন যেন কেউ বিরক্ত না করে। সন্ধের দিকে মিঠুর মাথা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে লাগলো। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল। মনে হচ্ছে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না। কিছুই মনে করতে পারছে না।

মিঠু পড়ার টেবিলে মাথা দিয়ে চোখ বুজে রইলো কিছুক্ষণ- নাঃ, সবই যেন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে।

মা চেম্বার থেকে ফিরে দেখলেন মিঠু টেবিলে মাথা দিয়ে বসে আছে। মা তো গেলেন রেগে, দিলেন জোরে ধমক “মিঠু হচ্ছে টা কি? এভাবে থাকলে চলবে? রিভিসন গুলো কে দেবে? দেখো গিয়ে, টিয়ার হয়ত এতক্ষণে সব রিভিসন দেওয়া হয়ে গেল, তুমি কি করছ?” মা মিঠুকে জাগানোর জন্য এগিয়ে গেলেন। মিঠু যেন বহু দূর থেকে মা-এর আওয়াজ শুনলো। কোনরকমে উঠে রিভিসন দিতে বসলো। মিঠুর সারাটা রাত কাটল একটা ধোঁয়াশার মধ্যে, আধো ঘুমে আধো জাগরণে।

পরীক্ষার হলে খাতাপত্র দেওয়া হয়ে গেছে। নিস্তব্ধ হলঘর। সবাই ঘাড় গুঁজে একমনে লিখছে, হঠাৎ শব্দ হলো। কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। হলের সবার ঘাড় ঘুরে গেল শব্দের উৎসের দিকে। শব্দের উৎস মিঠু।

মিঠু বেঞ্চ থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত। ইনভিজিলেটর তাড়াতাড়ি দৌড়ে এলেন। এম্বুলেন্স ডাকা, ফোন করা- সব মিলিয়ে এক গোলমালের মধ্যে মিঠুকে হাস্পাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।

বাবা-মা খবর পেয়ে ছুটে এলেন। ডাক্তার-রা বললেন- “এখানে এই রোগ সারবে না। মনে হচ্ছে হাইপার টেনশনে ব্রেন-এর শিরা ছিড়ে গেছে। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কোলকাতা নিয়ে যাওয়া হোক।” মিঠুরা যেখানে থাকে সেখান থেকে কোলকাতার বিমান সপ্তাহে তিনদিন। সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর ও প্রায় সত্তর কিলোমিটার। একমাত্র ভরসা হেলিকপ্টার, তাই মিঠুর বাবা হেলিকপ্টারে করে মিঠুকে নিয়ে গেলেন কোলকাতা।

ছোট মিঠুর এই অবস্থা দেখে মা তো কেঁদে অস্থির, “আমার মিঠুর কি হলো? কেন হলো?” হাহাকারের কোনো জবাব নেই। জবাব দেবার  কেউ নেই।

কলকাতায় দীর্ঘ চিকিত্সার পরে মিঠু ফিরে এল এক জড়বুদ্ধি হয়ে। কথা বলতে পারে না। চলতে ফিরতে পারে না। শুধু বেঁচে আছে এই যা। স্থান হলো হুইল চেয়ার। মিঠু শুধু করুণ ভাবে তাকিয়ে থাকে বোবা প্রশ্ন নিয়ে।

“কেন আমার এমন হলো? কে কেড়ে নিল আমার এই সুন্দর জীবন? আমার আঁকার রং, আমার তুলি, আমার সুন্দর মন, আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছা, পৃথিবীকে দেখার-জানার ইচ্ছা? পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর তা বুঝি এইভাবেই নষ্ট হয়ে যায়- সুন্দর মন, সুন্দর সম্পর্ক, সুন্দর ভালবাসা, সুন্দর ফুল, প্রজাপতি? সবকিছু এইভাবে প্রতিযোগিতার চাপে, মানুষের সুবিধের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে? কেউই কি প্রতিবাদ করতে পারবে না? তাকে বাঁচাতে পারবে না? এখানকার  ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার নাকি নষ্ট হয়ে যাবে মহাসড়ক বানাবার জন্য। এইভাবে কি প্রতিটি সুন্দর জিনিস মানুষ ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেবে? যা ভগবান সৃষ্টির খেয়ালে বানিয়েছেন তাকে নষ্ট করে দেওয়ার অধিকার মানুষ কোথা থেকে পেল?”

টিয়া প্রায়ই মিঠুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। টিয়া এলে মিঠুর চোখে এক হাসি ফুটে ওঠে। বোঝা যায় মিঠু খুশি হয়।

মা চেম্বার, হসপিটাল সব ছেড়ে দিয়েছেন। চব্বিশ ঘন্টা মিঠুর পাশে পাশে থাকেন। মিঠু কে ভালো করার চেষ্টায় নিজের ডাক্তারি বিদ্যা উজাড় করে দিতে চান। মিঠু তাদের একমাত্র মেয়ে। মায়ের চোখে জল আসে। কিন্তু, ভগবানের সৃষ্ট দুনিয়ার রহস্য এত সহজে মানুষ কি করে জানবে?

মিঠু এখন বোবা চোখে নীল পাহাড়ের রং বদল দেখে। ভাবে একটা ছবি আঁকবে কিন্তু পারে না- ভাবনাটা মাথাতেই থাকে। মিঠুর সঙ্গী এখন ভাবনা, চিন্তা আর প্রকৃতির ভালবাসা, ফুল, আকাশের রং বদল, পাখির নাচন, বাগানের প্রজাপতি। মিঠু দেখে আর ভাবে- এই দেখার ক্ষমতা টুকু কেউ কেড়ে নিতে পারেনি, ভাবনার ক্ষমতাও না।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Fiction and tagged , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s