ফ্লেমেনকো নাচের ছন্দ, স্প্যানিশ গিটারের সুর আন্দালুসিয়ার বাতাসে ভাসে। দক্ষিণ স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলে স্প্যানিশ ঐতিহাসিক তরঙ্গ যেন আধুনিক সময়ে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলে মুরিশদের বহুকালের রাজত্বের ছাপ ছড়িয়ে আছে।
আন্দালুসিয়ান সংস্কৃতিতে মুরিশরা নিজেদের রাজত্বের ছাপ তীব্র ভাবে রেখে গেছে আর সেই নিদর্শন ছড়িয়ে আছে আধুনিক সেভিয়ায়। ওরা রাজত্ব শুরু করেছিল সেভিয়ার আলকাজার থেকে। আর প্রায় ছ’শো বছর পরেও সেই আলকাজার রাজ প্রাসাদ আজও রাজ প্রাসাদের ভূমিকা পালন করে। এই রাজপ্রাসাদ আজও ব্যবহার হয় ও ইউনেস্কো এই প্রাসাদকে হেরিটেজ ঘোষণা করেছে।
আজও প্রচুর টুরিস্ট মুরিশ সাম্রাজ্যের মহিমার নিদর্শন দেখতে রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গনে ভিড় করে। তবে, Reconquista র ফলে এখানে মুরিশ ও ক্রিস্টান সাম্রাজ্যের নিদর্শন মিলে মিশে গেছে, এখন এই রাজপ্রাসাদের কিছু অংশের স্থাপত্যে দুই সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে। কোথাও কোথাও মুরিশ মোটিফের সঙ্গে মিশে গেছে ক্রিস্টান শিল্পকলা। মুরিশ স্থাপত্যে যোগ হয়েছে ক্রিস্টান স্থাপত্য। কোন কোন দেওয়ালে শুধুই ক্রিস্টান নিদর্শন। স্পেনের স্বর্ণযুগে এই প্রাসাদের অনেক সমৃদ্ধি হয়েছিল।
আলকাজার রাজপ্রাসাদের গায়ে গায়ে, থামে কোরান থেকে উঠে এসেছে সুক্ষ শিল্প বানী। হলুদ আলোয় অপূর্ব সুন্দর সুক্ষ কারুকাজ দেখে কত যে টুরিস্টের ক্যামেরা ভরে ওঠে এই প্রাসাদের ছবিতে, তার ইয়ত্তা নেই। জুনের দুরন্ত গরমেও এখানে বেশ এক ঠাণ্ডা পরিবেশ। আন্দালুসিয়ায় গরমের সময় বেশ ভালোই গরম পড়ে, কিন্তু সেই সময়ে মুরিশরা এমন করে প্রাসাদ তৈরি করতো যে গরম অনুভূত হত না।
রাজ প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে বাগানেও দেখা যায় মুরিশ ও ক্রিস্টান সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। জ্যামিতিক নক্সার মুরিশ বাগান এসে মিশেছে স্প্যানিশ রাজার বাগানে। ফুল, ফল, গাছ, পাখি ভর্তি এই বাগান গরমে ঘুরে ক্লান্ত টুরিস্টের ক্লান্তি জুড়িয়ে দেয়। ফোয়ারা মুরিস বাগানের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য। বাগানের জায়গায় জায়গায় জলের স্রোতের শব্দ টুরিস্টদের সঙ্গী হয়।
আলকাজার প্রাসাদ বাগানের ভেতরেই আছে রেস্টুরেন্ট। স্প্যানিশ ব্রেড, ঠাণ্ডা টুনা স্যালাডে দুপুরের খাবার সেরে নিয়ে একটু জিরিয়ে রাজ বাগানের ছায়াপথে আবার চলা শুরু হয়।
এই সময়ে সেভিয়া শহরটিকে প্রচুর টুরিস্টের চলাফেরা খুবই প্রাণবন্ত করে রেখেছে। আলকাজারের বাইরে সেভিয়া ক্যাথিড্রালের সামনে, অনেক ঘোড়া গাড়ির উপস্থিতি জায়গাটাকে এক ঐতিহাসিক ছোঁয়া দিয়েছে। আলকাজারের বাইরে রাস্তার মোড়ে Coca-Cola টি শার্ট পড়া ছেলে মেয়েরা বিলিয়ে চলেছে ঠাণ্ডা পানীয়। টুরিস্টদের হাতে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে Coca-Cola র টিন। এক টিন Coca-Cola নিয়ে পথ হাঁটি।
আজ ভাবি, সেই মুরিশ বাগান পথে চলা কি আমার নিজেকেই দেখা নয়? পথিকের পথ চলা শুধুই যে পথ হাঁটা তা তো নয়। এ যে নিজেরই মুখোমুখি হওয়া, নিজেকে জানা। এই বিশাল পৃথিবীতে নিজের ক্ষুদ্র অস্ত্বিত্বকে আবিষ্কার করারই আরেক নাম পথ চলা। পৃথিবীর পথে এই ভাবে পথ চলতে চলতেই জীবন যাত্রা করে বেলা অবেলার দিকে, আর পেছনে পড়ে থাকে আমারই পদ চিহ্ন আঁকা সুদীর্ঘ এক পথ।