ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে যখন মিদিপিরেনিস পাহাড় শ্রেণীর কোলে লুর্দে পা রাখলাম, এক হিমশীতল নির্জন ঠাণ্ডা হাওয়া আমাদের স্বাগত জানাল – হাড় কাঁপিয়ে দিল। নির্জন শীতল এই পাহাড়ি জায়গায় খুব তাড়াতাড়িই সন্ধ্যা নামে। তুলুস থেকে প্রথমে ট্রেনে Tarbes ও Tarbes থেকে বাসে Lourdes পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগে না।
ফ্রান্সের প্রতিটি ছোট বড় গ্রাম ও শহরের রেলস্টেশন বা বাস স্টপে এক ট্যুরিজম অফিস থাকেই। শুধু ফ্রান্সে নয়, সমস্ত ইউরোপেই দেখেছি ট্যুরিজমকে ওরা এক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যতই ছোট জায়গা হোক না কেন হাস্য মুখি সুন্দরীরা টুরিস্টদের সমস্ত ইনফরমেশন সহ জায়গাটির ম্যাপ ও ছোট্ট ঐতিহাসিক বিবরণ দিতে সদা তৎপর।
যদিও, Lourdes এর প্রধান আকর্ষণ বাইজেন্তাইন আদলে তৈরি রোমান ক্যাথলিক চার্চ Notre Dame du Rosaire de Lourdes বা Basilica of our Lady of the Rosary। কিন্তু, Lourdes এর অন্যান্য আকর্ষণের সন্ধানে টুরিস্ট অফিসে হানা দিতেই হয়। পরিষ্কার ইংলিশে ট্যুরিজম কর্মীরা জানালো Lourdes এর অন্য আরেক আকর্ষণ রোমান যুগের তৈরি দুর্গ – château fort de Lourdes ।
এগারো ও বারো শতাব্দীতে এই দুর্গ ছিল Counts of Bigorre এর বাসস্থান। মাঝের শতাব্দীগুলোয় অনেক হাতবদলের পরে সতেরো শতকে ফ্রেঞ্চ রিভলিউশনের সময় এই দুর্গে অনেক রাজকীয় বন্দীদের কয়েদ করা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে এখন জনসাধারণের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে।
দুর্গের উপর থেকে Lourdes এর অপূর্ব দৃশ্য দেখতে হলে অবশ্যই দুর্গে যাওয়া উচিত। ট্যুরিজম অফিসটি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটেই দুর্গের দরজা চোখে পড়ল। নানা ভাষায় ‘স্বাগতম’ কথাটি লেখা, যথারীতি হিন্দিকে খুঁজে পেয়ে এক রাজ্য জয়ের হাসি হেসে দুর্গের একদম উপর তলায় পৌঁছনোর লিফটের মুখে পৌঁছে গেলাম।
ধীর পায়ে এক শান্ত নীল সন্ধ্যা নামছিল Lourdes এর উপরে, সূর্য মিদি পিরিনিস পাহাড়ের আড়ালে যেতে যেতে শেষ আলো টুকু দিয়ে সাজাচ্ছিল Lourdes কে। সত্যি, উপরে পৌঁছে এক গভীর শান্তিময় নির্জনতায় যেন ডুবে গেলাম। শীত এখানে শান্ত নির্জন।
দুর্গে চারপাশ ঘুরে দেখে এক ঢালু বাঁধানো রাস্তা ধরে নিচের দিকে হেঁটে গেলেই Basilica of our Lady of the Rosary এর সামনে পৌঁছে গেলাম। মানুষ বিশ্বাস করে Lourdes এলে সমস্ত দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় হয়, এই জায়গার এক অলৌকিক শক্তি আছে। তাই প্রতি বছর গরমের সময় পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা এখানে তীর্থ করতে আসে।
সেই জন্যেই, ফ্রান্সে প্যারিসের পরে এখানেই প্রতি বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে প্রচুর হোটেল।
বেসিলিকার পেছনে পাহাড়ের গুহার ভেতরে ‘Our Lady of Lourdes’ এর শ্বেত পাথরের মূর্তির সামনে বিশাল বিশাল মোম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে এসে অনেকেই স্থির হয়ে সমস্ত জাগতিক চিন্তাকে দূরে রেখে প্রার্থনা করছে। গলন্ত মোমের মতোই মনের সমস্ত গ্লানি যেন গলে গলে পড়ছে। জ্বলন্ত মোমের উত্তাপ ও বেসিলিকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির বুক ছুঁয়ে ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া – সব মিলে মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতির রেশ মনে রয়ে যায়। এই নদীর জল খুবই পবিত্র, বোতলে বা জারিকেনে তাই সেই নদীর জল এখানে অনেক জায়গায় বিক্রি হচ্ছে।
Lourdes এসে মনে হল, এখানের আবহাওয়ার মধ্যে যেন এক ভালো লাগার রেশ ছুঁয়ে থাকে, যে ভালো লাগার ছোঁয়ায় আজও বুঁদ হয়ে আছি।