তুলুসের ক্যাপিটল চত্বরে প্রথম যেদিন টকটকে ফর্সা, বব ছাঁট এক মাথা লালচে চুল, টুকটুকে লাল লিপস্টিক, লাল কোট, সোনার সুন্দর ব্রোচ কোটের কলারে, কালো পেন্ট আর দামী চামড়ার জুতো পরনে চ্যাটার্জি কাকিমাকে দেখি, ওনার মুখের বাংলা শুনে ভেবেছিলাম – বাঃ ফ্রেঞ্চ হয়েও কি সুন্দর পরিষ্কার বাংলা বলছেন ভদ্রমহিলা। চমৎকার বাংলা শিখেছেন দেখছি।
আলাপ হওয়ার পরে খুবই আন্তরিক ভাবে যখন বললেন – এস একদিন বাড়ীতে, আলুপোস্ত আর সুক্তো খাওয়াবো। জানলাম ইনি বাঙালি, শুধু বাঙালি বললে ভুল বলা হবে, মনে প্রানে বাঙালি।
চ্যাটার্জি কাকু ও কাকিমা বহুদিন দেশ ছাড়া, ইউ এন এ চাকরির সূত্রে সত্তরের দশকে আফ্রিকার নানা দেশ, মিডিল ইস্টের নানা জায়গায় ঘুরেছেন, থেকেছেন। ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টের জন্যে তিনি যে কোনও দেশে থাকতে পারেন। যেহেতু, চ্যাটার্জি কাকুর ছাত্র জীবন ফ্রান্সে কেটেছে তাই অবসর জীবন ফ্রান্সেই কাটাবেন বলে স্থির করলেন।
তুলুসের রামন ভিলেতে চ্যাটার্জি কাকু কাকিমার সাজানো সুন্দর এপার্টমেন্টে পয়লা বৈশাখ, ক্রিসমাস, দুর্গা পূজা ছাড়াও বছরের নানা সময় আমাদের নিমন্ত্রণ বাঁধা। চ্যাটার্জি কাকিমার রান্নার হাত এতো ভালো যে কি বলব।সর্ষে ইলিশ, শুক্তো রাঁধেন বাঙালি মতে, ক্যাসুলে রাঁধেন খাঁটি ফ্রেঞ্চ মতে, পাস্তা রাঁধেন ইতালিয়ান মতে। শুধু কি রান্না? কোট সেলাই থেকে শুরু করে নানান হাতের কাজ কাকিমার নখ দর্পণে। ইউরোপের, ইন্ডিয়ার ইতিহাস কাকিমার মুখে মুখে। গানের গলা অতি চমৎকার, ফ্রেঞ্চ বলেন খাঁটি ফ্রেঞ্চের মতো, ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে। সত্যজিত রায় ও রবিশঙ্করের বিশাল ভক্ত দু’জনেই। ওনার গল্পে তাই এই দুই বাঙালির কথা ঘুরে ফিরে আসেই।
শনি বা রবিবার দুপুরে কাকিমার বাড়ীতে নিমন্ত্রণ মানেই পৃথিবীর নানা গল্প শোণার দিন, গানের দিন, পুরনো কিংবা নতুন ভালো সিনেমা দেখার দিন এবং সর্বোপরি সুস্বাদু খাবার খাওয়ার দিন। কত যে গল্প, সেই সময়ের আফ্রিকার গল্প– সাপের গল্প, আফ্রিকার তামার খনির গল্প, গাড়ি চালিয়ে ইউরোপ থেকে আফগানিস্থান যাওয়ার গল্প, মিশরের গল্প, বাগদাদের গল্প, লিবিয়ার গল্প, সেই সময়ের দেশের গল্প – ওনারা যখন দেশ ছেড়েছিলেন সেই সময়ের গল্প, কিশোর হেমন্তের গানের গল্প। কাকিমার গল্প বলার ধরণ এতো সুন্দর, যে সেই সময়ের এক ছবি ফুটে ওঠে। দু’জনেই জব্বলপুরের প্রবাসি বাঙালী, তখনকার সময়ের প্রেমজ বিবাহ ছিল তাঁদের। সেই সময় প্রবাসি বাঙালীদের বাঙ্গালিয়ানা আরও বেশী ছিল, এবং কাকিমা সেটা আজও ধরেও রেখেছেন। বিদেশের মাটিতে চ্যাটার্জি কাকু ও কাকিমার মতো মানুষের হঠাৎ দেখা পেয়ে আমাদের প্রবাসী জীবন যেন অনেক সহজ হয়।
প্রতিবছর ক্রিসমাসে কাকিমা আলো দিয়ে সুন্দর করে বাড়ী সাজান, আর সেই বাড়ী সাজানোর উৎসবে আমাদেরও ডাক পড়ে। আলো দিয়ে সমস্ত বাড়ী সাজানোর ফাঁকে খাওয়া দাওয়ারও বিরাট আয়োজন থাকে কাকিমার। শেষে অবশ্যই খুব ভালো এক সিনেমা দিয়ে দিন শেষ হয়।
দিন শেষ হয়, সময় ছোটে তীব্র বেগে কিন্তু পৃথিবীতে পুরনো কিছু মানুষের চিন্তা ধারা, ভাব ধারা তা যেন শেষ হয় না। পৃথিবী যেন চায় সেই সব পুরনো মানুষদের ধরে রাখতে, ফেলে আসা সময়কে ধরে রাখতে, আর সেই ধরে রাখার চেষ্টায় জীবনের কিছু ছবি আঁকি।
Sundor manush dujoner motoi sundor lekhata..
thank u…
অসাধারন মানুষ এই দুজন। আসা করি অনেক ভালো আছেন। ফ্রান্স এ যাবার শখ আমার বহু দিনের। আসা করি তাদের মতো আমিও ওখানে থাকার সুযোগ পাবও।
ধন্যবাদ। সত্যিই অসাধারণ মানুষ দু’জন। ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা রইল।
PayrChat is Bangladesh online social media and social networking service
https://payrchat.com