কিছু জীবন কথা – এক (Ramonville, France)


‘আই ডোন্ট লাইক ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইস সও পুয়র। পুওয় পিপল ইন দা স্ট্রীট, ডারটি, ক্রাউড, ট্র্যাফিক, হরিবল কন্ডিশনআই ডোন্ট লাইক টু সী পুয়র পিপল, ইট ইস পিটি’ –ডিসেম্বরের কণকণে ঠাণ্ডায় উষ্ণ ড্রয়িং রুমে বসে মি. বেলোই দক্ষিণ ফ্রান্সের স্থানীয় ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে হেসে বললেন।    

আমাদের উপরতলার ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক মি. বেলোইের সঙ্গে লিফটে বা লবিতে প্রায়ই দেখা হয়। ক্রিসমাসের আগে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করেছিলেন – এই ক্রিসমাসে কোথায় যাচ্ছ?

আমরা বলেছিলাম – না এবারে আর কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। তুলুসেই থাকব।

তিনি হেসে উষ্ণ নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন – কাম ফর আ ড্রিংক। লেটস এঞ্জয় দা ক্রিসমাস ইভ।

আমরাও সানন্দে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। ওনার এই কথায় আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। কি বলছেন? ওনার স্ত্রী হেসে বললেন – হি ইস জোকিং, ইউ নো ফ্রেঞ্চ আর হিউমারাস।

আমি মাথা নেড়ে বললাম – কথাটা তো খুব ভুল নয়। ইট ইস ট্রু। কিন্তু, ইন্ডিয়াতে প্রচুর বিলিওনিয়ার, মিলিয়নিয়ার আছে, লাইফ স্টাইল আছেযে ছবি আপনারা বাইরে থেকে বেড়াতে গিয়ে দেখেন সেটা সর্ব ক্ষেত্রে হয়তো সমান নয়।

-তবে সেই মিলিওনিয়াররা সেই পয়সা দিয়ে ওদের জন্যে কিছু করছেন না কেন, রাস্তা ঘাট পরিষ্কার করছে না কেন। আমেরিকায় যেমন হয়, এমনকি ফ্রান্সেও মিলিওনিয়াররা অনেক চ্যারিটি করে। – আবার মি. বেলোই বললেন।

সেবার মি. বেলোই ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়েছিলান। উন্নত, ঠাণ্ডা, পরিচ্ছন্ন, ধনী দেশ থেকে গিয়ে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের জীবনের দৈনিক সংঘর্ষের ছবি দেখে, অভাব দেখে চমকে গিয়েছিলেন। হয়তো বা আত্মতৃপ্তি হয়েছিল এই ভেবে যে – আমরা কত ভালো আছি। নিজে তিনি ইঞ্জিনিয়ার, স্ত্রী ডাক্তার বিশাল ফ্ল্যাট নিয়ে তৃপ্তিতে অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে। দুই ছেলেও প্রতিষ্ঠিত, কোন চিন্তা নেই। জীবন তাঁকে অভাব কি বস্তু, সংগ্রাম বা সংঘর্ষ কোন অনুভূতির নাম,কিছুই শেখায় নি।

-কিন্তু, আমার হিমালয় খুব ভালো লেগেছে। এতো শান্তি হিমালয়ে। কিন্তু, ইন্ডিয়ান মানুষের কোন সিভিক সেন্স নেই, এতো ঐশ্বর্য ধ্বংস করে দিচ্ছে। সারা দেশে শুধু নোংরা ছড়িয়ে রেখেছে, সমস্ত পাবলিক প্রপার্টি নোংরা, রাস্তা নোংরা। চারিদিকে প্লাস্টিক, কাগজ ফেলে রেখেছে। আমাদের ফাইভ স্টার হোটেলের বাইরেই নোংরার ডিপো, হাওয়ায় সেই নোংরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সবাই বলে ইন্ডিয়া ইস গ্রোয়িং, কিন্তু কি ভাবে গ্রো করছে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। যদি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার গ্রোথ না হয় তাহলে কিসের গ্রো? এগেন আই সোঁ পিপল আর ভেরি পুশি। – একটানা বলে থামলেন মি. বেলোই।

ওনার কথা শেষ হওয়ার পরে ড্রইং রুমে এক নির্জনতা ছড়িয়ে পড়ল। সবাই নীরবে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে তুথপিক দিয়ে একটা একটা করে অলিভ তুলে মুখে ফেলতে লাগল। মিসেস বেলোই হাতে আরেক প্রস্থ স্মোকড স্যাল্মনের স্টারটার নিয়ে এলেন। মি. বেলোই আবার বললেন – তবে শিক্ষিত ইন্ডিয়ানরা খুব ইনটেলিজেন্ট,আমি জানি, ওরা আমেরিকার ভালো ভালো বড় জায়গায় পৌঁছে গেছে এমনকি ইউরোপেও আই লাইক দেম, আই লাইক ট্যালেন্টেড, এডুকেটেড ইন্ডিয়ান। ইন্ডিয়াতে আরও বেশী এডুকেশন দরকার, তাহলে বোধহয় আরও ভালো হবে, ক্লিন হবে

সেই সন্ধ্যার আলোচনা নানান খাতে বয়ে চলেছিল। মি. ও মিসেস বেলোই পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছেন, প্রচুর অভিজ্ঞতা। একে একে সেই সব অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে শুনতে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেল বুঝতেই পারি নি। সম্বিৎ ফিরল পাশের গির্জার রাত বারোটা বাজার ঘন্টার আওয়াজে।

আমি ভাবতে বসলাম। সত্যি এই ঠাণ্ডা রাতে উষ্ণ আস্থানায় বসে ভারতবর্ষের গরীবের কথা, মালিন্যের কথা আলোচনা করা কতই সহজ। অথচ সবই তো সত্যি কথা। মি. বেলোইের কথা যেমন সত্যি তেমন ভারতবর্ষের উন্নতির কথাও সত্যি। ভারতবর্ষের উন্নতিকে বিদেশিরা নিজেদের মাপকাঠিতে ফেলে মাপতে চাইছে, নিজেদের চশমার লেন্স দিয়ে দেখতে চাইছেআমার মনে হয়, ভারতবর্ষের উন্নতি অনেকটা ফল্গু নদীর চোরা স্রোতের মত, চোখের আড়ালে বয়ে চলেছে, যে কোনও দিন বান আসতে পারেভারতবর্ষ সহিষ্ণুতার আরেক নাম। ভারতের মানুষ সমস্ত অব্যবস্থাকে, অনিয়মকে মানিয়ে নিয়ে কাজ করে চলেছে, সভ্যতার অগ্রগতির পথে ঠিকই পথ খুঁজে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষ এক আশার নাম, এক ভবিষ্যতের নাম। জানি সেই আশা ও ভবিষ্যতের দিকে আজ অনেকেই তাকিয়ে আছে।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Memory-Lane and tagged , , , , , . Bookmark the permalink.

1 Responses to কিছু জীবন কথা – এক (Ramonville, France)

  1. Susmita বলেছেন:

    True!!!!!

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান