কিছু জীবন কথা – দুই (Toulouse, France)

‘তোমাদের দেশকে প্রথম আমি শুধুই রবিশঙ্করের নামে চিনি। আমি তার মিউজিক খুবই ভালবাসি’ – ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিল প্রোফেসর আরবিওলের নির্জন বসার ঘরে বসে। ছোট্ট, সুন্দর মধ্যযুগীয় বসার ঘরটি প্রোফেসরের। কাঠের কড়িকাঠ দেওয়া নিচু ছাদ, সুইডেন থেকে আনা এক ফায়ারপ্লেসের কাঠের আগুনের সামনে বসে উত্তাপ নিতে নিতে তাঁর কথা শুনছিলাম। ঘরে এক হলুদ টিমটিমে আলো, ঘরের এক কোণ আসন্ন ক্রিসমাসের উদ্যেশ্যে স্বল্প আলোয় সাজানো, পরিবেশে যেন বহু পুরনো ফ্রেঞ্চ জীবনযাত্রার ছাপ। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র নাকি এন্টিক, খাবার টেবিলটি প্রায় দেড়শ বছর পুরনো, ঘরের কোণের এক লেখার দেস্ক নাকি লুই সিক্সের সময়ের।

প্রোফেসর আরবিওলকে গত পাঁচ পছর ধরে দেখছি। ফর্সা, ছিপছিপে, হাসিখুশি চেহারার মধ্যবয়সী ফ্রেঞ্চ প্রোফেসর আরবিওল আমাদের ফ্রেঞ্চ শেখান। অক্টোবর থেকে যখন নতুন ছাত্র ছাত্রি নানা দেশ বিদেশ থেকে তুলুস ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসে, সান্ধ্য ফ্রেঞ্চ ক্লাস শুরু হয়। চলে শেষ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কোন কোন মানুষ থাকে যাদের দেখলেই মনে হয় দিন ভালো যাবে, অকারণ মন খুশী হয়ে যায়। প্রোফেসর আরবিওল সেই দলের মানুষ। খুবই প্রাণবন্ত ভাবে ফ্রেঞ্চ পড়ান। ভাষা শিক্ষাকে অকারণে ব্যকরণ, নিয়মের ভারে ভারাক্রান্ত করেন না। প্রায়ই টিনটিনের ফ্রেঞ্চ কমিকস, কিংবা প্রচলিত ফ্রেঞ্চ গান ইত্যাদি দেখিয়ে ফ্রেঞ্চ শেখান। সারাদিনের নানা কাজের শেষে সন্ধ্যা ছটায় তাঁর ক্লাস ছাত্র ছাত্রীদের যেন সতেজ করে।

জীবনকে কতটুকু সরল সহজ করা যায় তা প্রোফেসর আরবিওলের কাছে শেখা যায়। বললাম – আপনি কখনো ইন্ডিয়া গেছেন?

না, আমি এরোপ্লেন ভয় পাই। এরোপ্লেনে করে কোথাও যাওয়া তাই আমার হয় নি। জীবনে শুধু একবার এরোপ্লেনে চেপেছি। – আরবিওল হেসে উত্তর দিল।

আমি বললাম – তাহলে আপনি জাহাজে করে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন, এক অন্য অভিজ্ঞতা হবে।

হ্যাঁ, রিটায়ার করার পরে আমার তো তাই ইচ্ছা। পুরনো দিনের মতো জাহাজে করে পৃথিবী ঘুরে দেখার। – ছোট্ট ক্রিস্টেলের গ্লাসে পোর্টও ওয়াইন ধালতে ধালতে বললেন আরবিওল।

ছোটখাটো মিষ্টি চেহারার ওনার স্ত্রী, হেসে বললেন – ও এমনি, একটু অন্যরকম। সেই কলেজে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সারা জীবন কাটিয়ে দিলাম ওর সঙ্গে, একটুও বদলায় নি।

দু’জনের মুখেই মধ্যবয়সের প্রশান্তির ছাপ, দুই মেয়ে গ্রামের দিকের স্কুলে পড়ায়। নাতি নাতনি নিয়ে এক সাধারণ সুখী ফ্রেঞ্চ জীবন।

ওনার স্ত্রী বললেন – যদিও আমি ইন্ডিয়া যাইনি, ইন্ডিয়া সম্বন্ধে অনেক পড়েছি। ইন্ডিয়ান মিউজিক আমার খুব ভালো লাগে। আমার মেয়ে একবার শান্তিনিকেতনের বাউলদের সঙ্গে গিয়ে অনেকদিন ছিল।

দু’জনে মিলে ওনার মেয়ের ইন্ডিয়া ঘোরার গল্প শোনালেন। দিল্লিতে কি ভাবে এক ট্যাক্সি চালক ঘুরপথে ঘোরাতে ঘোরাতে প্রচুর টাকা চেয়েছিল, অন্য এক দামী হোটেলে নিয়ে তুলেছিল, মেয়ের সমস্ত টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিল দিল্লিতে, পরে মেয়েকে এখান থেকে টাকা পাঠাতে হয়েছিল। পরে বোলপুরের রাঙামাটির ধুলি রঙ্গিত গ্রামে এক বাউল পরিবারের সঙ্গে গিয়ে থেকেছিল অনেকদিন।

এক ফ্রেঞ্চ মেয়ে বোলপুরের গ্রামে গিয়ে থাকলে যেমন হয় আর কি – ও যেখানেই যেত পেছনে নাকি প্রচুর বাচ্চা ওকে অনুসরণ করতো – বলে তিনি মুচকি হাসলেন। আমি মানস চক্ষে যেন সেই দৃশ্য দেখতে পেলাম, আমারও হাসি পেল।

তিনি বললেন – একে ওপরের কোন ভাষা না জেনেও শুধু মাত্র ইঙ্গিতে কথা বলে প্রায় এক মাস থেকেছিল আমার মেয়ে। পরে ফেরার সময়, সেই বাউল পরিবার ছেড়ে আসার সময় আমার মেয়ে প্রচুর কেঁদেছিল, এমনকি আমাদের ছেড়ে যাওয়ার সময়ও আমার মেয়ে এতো কাঁদেনি। এখনো আমার মেয়ে বলে সেই বাউল পরিবারের সঙ্গে কাটানো সময় তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়, best days of her life।

আবার যোগ করলেন – মনে হয় ভারতবর্ষ এক পেঁয়াজের মত, পরতে পরতে নানান জীবন ধারা, নানান আবেগ। আর সমস্ত আবেগই যেন স্থান পায় তোমাদের দেশে, তাই না?

ভাবি – হয়তো তাই, আমার দেশে কেউ রাখে মনের খবর আবার কেউ রাখে টাকার খবর। সেখানে সবাই বাঁচে নিজের স্বপ্ন সম্বল করে। ভারতবর্ষে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ পেঁয়াজের খোসার মতোই পাশাপাশি, ঠাসাঠাসি করে বাস করেও নিজের অস্ত্বিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে।

ডিনার টেবিলে বসে খেতে খেতে এ কথা সে কথায় সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। ডিনার শেষে আরবিওল এক ইন্সট্রুমেন্ট বাজিয়ে শোনালেন। Bach এর সময়ে যে ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে সুর বাজানো হত সেই আদলে তৈরি সেই ইন্সট্রুমেন্ট। তাঁর শখ পুরনো দিনের ইউরোপের সমস্ত সুর সেই বাদ্যযন্ত্রে বাজানো। আরবিওল সেই যন্ত্রের প্রচুর তারে হাত রাখা মাত্র এক সুরেলা সুর মধ্যযুগীয় বসার ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। নির্জন রাতে, আধো আলোয় আলোকিত বসার ঘরে অতীতের সুর আমাদের যেন এক অন্য পৃথিবীর কথা মনে করায়।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Memory-Lane and tagged , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s