সেপ্টেম্বরের শুরুতে বাতাসে হালকা ঠাণ্ডার ছোঁয়া, কখনো বা উত্তুরে মৃদু হাওয়ার এক শিরশিরে শীতের ছোঁয়ায় মন কেমন করে। এই সময় এখানে দিনের রঙ খুবই উজ্জ্বল। আকাশ ঘন নীলের মাঝে পেঁজা তুলোর মত মেঘের সম্ভার নিয়ে সাজে আপন মনে। হাওয়ায় যেন কেমন এক পুজো পুজো গন্ধ। এমনি দিনে সপ্তাহান্তের ছুটিতে কাছে পিঠে কোথাও বেড়িয়ে আসা যেতেই পারে।
এক ফ্রেঞ্চ বন্ধু অনেক দিন ধরে বলছে, মিদিপিরিনিস পাহাড়ের কোলে নির্জন গুজেত গ্রামে ওর কাঠের এক বাড়ী আছে। সবাই মিলে এক উইক এন্ডে বেড়িয়ে এলে কেমন হয়। শুক্রবার বিকেলের দিকে বেড়িয়ে পড়লাম দল বেঁধে। সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে গেলাম। সন্ধ্যের ধূসরতা ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই এই জায়গাটাকে দল বেঁধে একটু দেখে নিলাম।
এখানে পাহাড়ের গায়ে কাঠের অনেক ছোট ছোট ঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেকেই নির্জনে কিছুদিন ছুটি কাটাতে এখানে চলে আসে। শীতে এই অঞ্চল ঘন তুষারের আবরণে ঢাকা থাকে, তখন এই অঞ্চলে স্কি করতে সবাই দল বেঁধে আসে।
পরেরদিন উজ্জ্বল সকালে দূরে ধূসর নীল মিদিপিরেনিস পাহাড় শ্রেণী, ঘন নীল আকাশ, ঘন সবুজ জঙ্গলের প্রেক্ষাপটে ঘুম ভাঙল। এখনো এখানে খুব বেশী ঠাণ্ডা পড়ে নি, ঠাণ্ডা পড়া সবে শুরু হয়েছে, দূরের পাহাড় শ্রেণীর চূড়ায় কিন্তু কিছু তুষার এখনো জমে আছে। ডিসেম্বরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জড় হয়ে যায় এই জায়গা। জানালা খুলতেই একরাশ তাজা এলোমেলো ঠাণ্ডা হাওয়া মুখ ছুঁয়ে গেল – ভালো লাগল।
শীতের সকালে যখন রোদের নরম উত্তাপ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, কাঠের বেলকনিতে বসে সবাই সকালের খাবার খাচ্ছি – দেখি নানান বয়সের এক দল বেড়াল গুটি গুটি আমাদের সামনে এসে বসেছে। যথারীতি ওরাও আমাদের ব্রেকফাস্টে ভাগ বসালো – গরম দুধ দিয়ে শুরু করে ব্রেড-বাটার সবই খেল সবাই মিলে। অবশ্য ওদের স্প্যেশাল খাবারও দেওয়া হল – এই বেড়াল দল তৃপ্তি সহকারে সবই খেল। শুধু কি সকালের খাবার ? আমাদের দুপুরের মেনু স্যালমন মাছ ভাজাতেও ওরা ভালোই ভাগ বসাল, এমনকি গরম ওভেনে যে কিছু মাছ ভাজার তেল পড়েছিল, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন দেখল ঠাণ্ডা হয়েছে – বেশ চেটে চেটে সমস্ত তেলই খেয়ে ফেলল। তারপর ঘরের সামনেই নরম ঘাসের বিছানায় গা এলিয়ে রোদ পোহাতে শুরু করল। মিদিপিরেনিস পাহাড়ের বেড়ালদের কি নিশ্চিন্তির জীবন!
দুপুরের খাওয়া শেষ করেই আমরা দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়লাম পাহাড়ি পাকদণ্ডী ধরে হাঁটতে। নরম রোদ পিঠে নিয়ে দূরের যে পাহাড় চূড়া এখানে আসার পর থেকেই দেখছিলাম তার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু হল। অদ্ভুত স্বচ্ছ এখানের আকাশ, এক ফোঁটা মেঘ নেই, নির্মল বাতাস। হাসি গল্প – কথায় পথ যে তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায়। স্কি করার জন্যে রোপওয়ে গুলো এখন স্তব্দ হয়ে আছে। এখানে সন্ধ্যা ঝুপ করে নামে, ঠিক পাহাড়ের ওপারে সূর্য চলে যাওয়া মাত্র জায়গাটাতে সন্ধ্যার ধূসর ভাব নেমে এলো। পাহাড়ের চূড়ায় বসে এখানের ঠাণ্ডা সন্ধ্যা নামা দেখার এক অন্য রোমাঞ্চ অনুভব হয়, নিচের গ্রামটিও কুয়াশায় ঢেকে গেল। এখানের এই পাহাড় চূড়ায় বসে, কাল আবার নিচের ঐ গ্রামের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেল।
কাঠের বাড়ীতে ফিরতে ফিরতে নিকষ কালো ঘন অন্ধকারে চারিদিক ছেয়ে গেল। রাতের স্বচ্ছ আকাশে একে একে প্রচুর তারা উঁকি দিতে শুরু করল। I see skies of blue … clouds of white/Bright blessed days …dark sacred nights/And I think to myself…What a wonderful world ।