দুভ্রভনিক থেকে স্প্লিটের পথে ( Dubrovnik to Split journey)

যত দূর চোখ যায় উঁচু নিচু রুক্ষ পাথুরে জমি, জন মানব হীন এক উদাসীন রুক্ষতা এই অঞ্চলের নেড়া পাহাড়ে – শুনেছি শীতে এই সমস্ত অঞ্চল ঘন বরফের চাদরে মোড়া থাকে- তখন বাস চলাচল বন্ধ হয় কিংবা বাস খুবই কমে যায়। গ্রীষ্মে যখন বরফ গলে রুক্ষ মাটি বেড়িয়ে আসে কিছুদিনের জন্যে – গাছপালা গজাতে না গজাতেই শীত চলে আসে। কাজেই সেই রুক্ষ ভূমি রুক্ষই থেকে যায়। ভাবা যায় – কিছুদিন আগেই এই রুক্ষ ভূমি এক রণক্ষেত্র ছিল – আজ নিবিড় শান্তি এই অঞ্চলের আকাশে বাতাসে, মানুষের মনে। যুদ্ধের ক্ষত, বিপর্যয়, ক্ষয়-ক্ষতি সমস্ত ভুলে নতুন উদ্যমে পর্যটনকে কেন্দ্র করে উন্নতির, অগ্রগতির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে এই অঞ্চলের মানুষ।

নির্জন প্রান্তরে কখনো বা মাঝে মাঝে এক পাল ভেড়ার সঙ্গে এক দু’জন লোক দেখা যায়। ইউরোপের এই অঞ্চলের জনজীবন যেন ইউরোপিয়ান সময়ের থেকে একটু পিছিয়ে, তবে সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় মনে হয় খুব বেশী দিন আর পিছিয়ে থাকবে না। পাহাড়ি পাথুরে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে বাস চলেছে, এমনকি পথ সঙ্গী অন্যান্য বাস বা গাড়ি কিছুই নজরে আসে না এখানে। কিছুদূর সমুদ্র ছিল সঙ্গে, এখন শুরু হয়েছে নিঃসঙ্গ পাহাড়ি রাস্তা। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কুয়াশা থমকে গিয়ে এক অদ্ভুত ছবি তৈরি করেছে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে বাতাসে এখনো শীতের ছোঁয়া নেই, আবহাওয়া অনুকূল।

আগেই জেনে এসেছিলাম যে এই পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বাসের বাঁ দিকে বসার চেষ্টা করতে হবে। এই অঞ্চলে অনেক কিছুই তথাকথিত ইউরোপিয়ান নিয়ম মেনে চলে না। টিকিটে বাসে বসার কোন সিট নম্বর নেই- যে কোন সিটে বসা যায়। তাই যথারীতি তাড়াহুড়ো করে বাঁদিকের সিট দখল করতে হল। আসলে বেড়াতে এসে সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে যেটুকু লড়াই তা বোধহয় সমস্ত জাপানিজ টুরিস্টদের সঙ্গেই করতে হয়। দেখি জাপানিজ টুরিস্টরা বাসের সমস্ত বাঁদিক দখল করে বসেছে। ইউরোপের যেখানেই গেছি দেখেছি দলে দলে জাপানিজ টুরিস্ট হানা দিয়েছে।

পাহাড় শ্রেণীর রুক্ষতার মাঝে অনেকক্ষণ চলার পরে হঠাৎ আবার দিগন্তে সমুদ্রের নীল দেখা দিল। যতই এগোই সেই নীল আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ধীরে ধীরে ম্যাজিকের মতো এক সৈকত শহর দেখা গেল – মাকারাস্কা রিভেইরা। ক্রোয়েশিয়ার আরেক বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র, ফ্রেঞ্চ রিভেইরার মতোই এই সুন্দর সৈকত শহরটি এখনো অনেকের ভ্রমণ তালিকায় মনে হয় যোগ হয় নি। চারিদিকের রুক্ষ পাহাড় শ্রেণীর মাঝে পথের সুন্দর সাজানো এই শহর দেখে মনে হয় যেন আলাদিন হঠাৎ নিজের মনে এখানে শহরটি বানিয়ে গেছে। এখানে কিছুক্ষনের জন্যে বাস থেমে কিছু যাত্রী নিয়ে আবার শুরু হল যাত্রা।

বাসের এই পথে ক্রোয়েশিয়ার সীমানা ছেড়ে বেড়িয়ে আরেক দেশ – বস্নিয়া-হারজিগোভিনিয়ার কয়েক কিলোমিটার পার হতে হবে আবার ক্রোয়েশিয়ায় ঢুকতে হবে। কিছুদূর যাওয়ার পরেই অন্য দেশের সীমানা রক্ষীরা স্বাগত জানালো, অনেকেই বাস থেকে নেমে এই দেশের ফটো তুলতে শুরু করে দিয়েছে। প্র্যতেকের পাসপোর্টে বসনিয়া-হারজিগোভিনিয়ার ছাপ হয়ে গেল। বাস চলতে শুরু করলে, বাসের উত্তেজিত জাপানিজ টুরিস্ট দল কল কল করে নিজেদের ভাষায় নানান মন্ত্যব্য করতে শুরু করল ও একে অপরকে নিজেদের তোলা ফটো দেখাতে শুরু করল। কিছুদূর চলার পরেই পাসপোর্টে আবার ক্রোয়েশিয়ার সীমানা রক্ষীদের ছাপ নিয়ে যথারীতি বাস গন্ত্যবের দিকে চলতে শুরু করল।

কখনো কখনো জীবনে গন্ত্যব্যটাই মুখ্য হয়ে ওঠে, পথের সৌন্দর্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই আমরা পৌঁছে যাই গন্ত্যব্যে কিন্তু পূর্ব ইউরোপের এই অপরূপ, অচিন পথে পুরো পথকেই আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করলাম।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Bosnia and Herzegovina, Croatia, Europe, Travel and tagged , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s