রোকামাদুরের সোনালি রোদ্দুর (Rocamadour, France)

April 2013, Rocamadour, France

“তোমরা রোকামাদুর যাও নি ?” “সে কি?”

 “রোকামাদুর অপূর্ব। তুলুসে এতোদিন আছ রোকামাদুর একবার অন্তত যাও।”

 “রোকামাদুরের চীজ! আহা! কি যে স্বাদ।”

“রোকামাদুরের উপরে সোনালি রোদের খেলা দেখনি? খুব মিস করেছো।”

অনেক দিন ধরে তুলুস বাসীদের এই ধরণের টিপ্পনী শুনতে শুনতে একদিন ঠিক করেই নিলাম, নাঃ, আর টিপ্পনী শুনব না। টিপ্পনীর জবাব দেব- হ্যাঁ, রোকামাদুরে গিয়েছি। রোকামাদুরের চীজ খেয়েছি। শীতে রোকামাদুরে নরম রোদ্দুরের উত্তাপ নিয়েছি।

এক শনিবারের সকালে বেড়িয়ে পড়লাম রোকামাদুরের উদ্দ্যেশ্যে। নীল আকাশে একফোঁটা মেঘের ছোঁয়া নেই, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ঝকঝকে রোদ্দুরে রোকামাদুরের পাহাড়ি পাকদণ্ডীতে আমাদের হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।

এই সময়ে পথে দেখা যায় দক্ষিণ ফ্রান্সের প্রকৃতির এক অদ্ভুত বৈরাগী সাজ। এক সময়ের সবুজ ঘাস, রোদে ঝলসে গিয়ে কেমন যেন এক খয়েরি হয়ে যায়, তাই উঁচু নিচু ঢালু জমি হলুদ খয়েরি প্যাচে এক অপূর্ব ছবি তৈরি করে। গাছের শুকনো খালি ডাল নিঃস্ব উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, গাছেরা প্রতিটি ঝরে যাওয়া পাতার জায়গায় নতুন পাতা গজানোর অপেক্ষায় থাকে। জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির এই পাতা ঝরার যেন খুবই সাদৃশ্য পাই।

খাড়া পাথুরে পাহাড়ের খাঁজে আপাতদৃষ্টিতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে ঝুলন্ত Rocamadour চার্চ ও গ্রামটি ফ্রান্সের অন্যতম টুরিস্ট গন্ত্যব্য। এই জায়গা শুধু যে সুন্দর তা নয়, এই জায়গা ক্রিশ্চান ধর্মের অন্যতম ধর্মীয় পীঠস্থান, অলৌকিক উপায়ে রোগ সারাতে গরমের সময়ে প্রচুর মানুষ এখানে আসে, তাই এখানে বড় হাসপাতালও আছে। অলৌকিকতার প্রতি মানুষের বিশ্বাস সব দেশেই সমান, বিজ্ঞান যেখানে থেমে যায় অলৌকিক শক্তির শুরু বোধহয় সেখান থেকেই। আজও মানুষ বিশ্বাস করে – miracle শব্দটিকে। মধ্য যুগ থেকেই এই পাহাড়ি জায়গা Shrine of the Black Virgin এর উদ্দ্যেশ্যে নিবেদিত এক ধর্মীয় স্থান ছিল।

রোকামাদুরের উৎপত্তি, তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে অনেক কিংবদন্তি গল্প গাথা প্রচলিত এখানে – কিছু সত্যি ইতিহাস আবার কিছু শুধুই গল্প। রোকামাদুরের উৎপত্তি নিয়ে ফ্রেঞ্চ প্রচলিত কিংবদন্তি বলে – বাইবেলের এক চরিত্র Zacchaeus তিনি, St Veronica র স্বামী, ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্যে ফ্রান্সের এই অঞ্চলে চলে আসেন ও শেষ জীবন এখানেই কাটান।

পরে, এখানে যখন ১১৬৬ তে পাহাড়ের পাথুরে খাঁজে এক অবিকৃত মৃত দেহ আবিষ্কৃত হয়, প্রচার হয়ে যায় Zacchaeus এর মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তাঁকে ফ্রেঞ্চে বলা হত St Amadour। St Amadour এই পাহাড়ে জঙ্গলে শেষ সন্ন্যাসী জীবন কাটিয়েছিলেন। কিংবদন্তির সত্যি রূপ দেখতে পায় ফ্রান্সের মানুষ।

তারপর থেকেই এই জায়গা ক্রিশ্চানদের পবিত্র তীর্থস্থান হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের রাজা রানী থেকে শুরু করে ফ্রান্সের বহু রাজা রানী রোকামাদুরে প্রার্থনার জন্যে এসেছিলেন। এখনও প্রতিবছর প্রচুর মানুষ নানা দিক থেকে আরোগ্য কামনায় এখানে আসে। রক কেটে তৈরি এই পবিত্র জায়গায় St Amadour এর সমাধি পাওয়া গিয়েছিল, তাই নাম হয় – Rocamadour।

পাহাড়ি পাথুরে পাকদণ্ডী উপরের দিকে চলে গেছে। পথে দু’পাশে জঙ্গলের মাঝে শীতের দুপুরের এক আলো ছায়া ঘেরা শীত শীত অনুভূতি জড়িয়ে ধরে। রোকামাদুরের এক অংশে পাহাড়ের ছায়া যখন খুব তাড়াতাড়িই সন্ধ্যার প্রস্তুতি নেয়, আরেকদিকে তখন উজ্জ্বল রোদের খেলা চলে।

বর্তমানে শান্ত ছোট এই গ্রামের অর্থনীতি – চীজ ইন্ডাস্ট্রি। এখানকার ছোট গোলাকার চীজ খেতে খুবই ভালো। স্থানীয় রেস্টুরেন্টে স্যালাদের সঙ্গে পরিবেশন করে রোকামাদুরের বিখ্যাত চীজ। রোকামাদুরের খোলা রেস্টুরেন্টে এপ্রিলের নরম রোদে পীঠ রেখে রোকামাদুরের চিজে কামড় দিতে দিতে মনে হয় – রোকামাদুরে সোনালি রোদের খেলা সত্যি সুন্দর, মোহময়, অপরূপ, অলৌকিক।

শত শত বছর ধরে অনেক কিংবদন্তি, অনেক miracle ঘটিয়েছে এই জায়গা, আজ এই রোকামাদুর চার্চ ও ছোট্ট শান্ত গ্রামটি বহু মানুষের বিশ্বাস ও আশার প্রতীক। তাইতো বহু মানুষ দু’দণ্ডের শান্তির খোঁজে ছুটে আসে এই পাথুরে গ্রামে।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel and tagged , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান