April 2010, Burano, Italy
এখানে এসে মনে হয় – এ’তো ছেলেবেলায় ভোর রাতের স্বপ্নে দেখা খেলাঘরের ছবি। স্বপ্নেই বোধহয় এমন রামধনু রঙের বাড়ী পাশাপাশি দেখেছি। বাস্তবে যে একটা পুরো দ্বীপের বাড়ীর মানুষেরা, নিজেদের বাড়ী রামধনু রঙে সাজানোর ছেলেমানুষি খেলায় মেতে ওঠে, তা এখানে না এলে জানবোই বা কি করে? বরাবর তো দেখে এসেছি অমুক-তমুক বাবুর বাড়ীর রঙের মতোই নিজের বাড়ী রাঙ্গানোর রেষারেষি। তাই অবাক লাগে বই কি।
দু’ধারে রামধনু রঙা গা ঘেঁষা ঘেঁষি বাড়ীর সারি, মাঝে বয়ে গেছে সবুজ জলের ক্যানাল। জলে সেই রঙিন বাড়ীর রঙিন ছায়া পড়েছে।
ভেনিসে জলযানের তিনদিনের পাস তো কাটাই ছিল, তাই ভেনিস থেকে স্টিমারে করে খুব সহজেই পৌঁছে যাই এখানে। এই দ্বীপে হাঁটা ও সাইকেল ছাড়া অন্য কোন যানবাহন নেই। ও হ্যাঁ, দু’পাশের বাড়ীর মাঝে যে সবুজ ক্যানাল বয়ে গেছে সেখানে নৌকোই প্রধান বাহন।
এই দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দা খুব কম। আগে মাছ ধরাই এখানের মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল, আর বাড়ীর মহিলারা হাতে লেস বুনে নানান সুদৃশ্য লেসের নানান জিনিষ তৈরি করতো। এখনো সেই পুরনো পেশা রয়ে গেছে অনেকের। অবশ্য এখন নতুন অনেক জীবিকা হয়েছে এখানের বাসিন্দাদের, যেমন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, কাচের কাজ। মহিলারা এখনো লেসের কাজ করে, তবে মেশিনে। বুড়ানোর লেসের তৈরি কাপড় বিখ্যাত। রঙিন বাড়ীর নিচের তলায় অনেকের ছোট্ট দোকানে স্যুভেনির এর সঙ্গে লেসের কাজও বিক্রি হচ্ছে।
পৃথিবীতে সমস্ত আশ্চর্য কর্মকাণ্ডের পেছনে হয়তো মানুষের নিজস্ব সুবিধা জড়িয়ে থাকে।মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া শুনতে যত ভালো লাগে, বাস্তবে মাঝ সমুদ্রে মানুষ ততই নিঃসঙ্গ, শীতার্ত। এই দ্বীপের ধীবররা যখন মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়, দূর থেকে, গায়ে গায়ে তৈরি বাড়িগুলোর মধ্যে যাতে নিজের বাড়ীকে দেখতে পায় ও চিনতে পারে তাই প্রত্যেকে নিজেদের বাড়ীকে আলাদা আলাদা রঙ করে। নিঃসঙ্গতার মধ্যে নিজের রঙিন বাড়ীর উষ্ণতার ছোঁয়া ধীবরের বুকে সাহস যোগায়, সঙ্গ দেয়। বিশাল সমুদ্রের অনিশ্চয়তার মাঝে রঙিন গৃহকোণের আশ্রয় ধীবরকে নিশ্চয়তার খোঁজ দেয়।
জলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বাস করা খুব যে সহজ তা নয়। প্রতি বছর শীতে বন্যায় ডুবে যায় এই দ্বীপের বাড়ীগুলোর নীচতলা। তাই স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকেই এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এখন লোকবসতি অনেক কমে গেছে এখানে।
রঙিন খেলাঘরের এই দ্বীপে হাঁটতে হাঁটতে যেন হারিয়ে যাই এক অন্য জগতে।