February 2009, Antibes, France
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হয়ে হওয়ার পর পিকাসোর প্যারিস শহরের ঠাণ্ডা ও ধূসর ধোঁয়াশায় আর থাকতে ভালো লাগে নি। সমুদ্র, সূর্য, আলো ও অন্যরকম জীবনের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছিলেন ফ্রান্সের দক্ষিণে। খুঁজে নিয়েছিলেন মেডিটেরিয়ান সমুদ্রের ধারে শান্ত এন্টিব (Antibes) শহরে শেষ জীবনের ঘর। এই শহরের জীবন যাত্রা চলে সহজ তালে।
Château Grimaldi ১৪ শতকের এক রোমান দুর্গ, এখন সেটা এন্টিব শহরের সম্পত্তি ও পিকাসো মিউজিয়াম। পিকাসোর স্টুডিয়ো ছিল মেডিটেরিয়ান সমুদ্রের দিকে মুখ করে Château Grimaldi র উপরের দিকে এক ঘরে। এখানে পিকাসো তাঁর শেষ জীবনের অনেক দুর্মূল্য শিল্প সৃষ্টি করেছেন ও Château Grimaldi কে দান করেছিলেন। বলেছিলেন যাদেরই পিকাসো দেখার ইচ্ছে হবে তাঁদের এন্টিবে আসতেই হবে। এই এন্টিব পিরিয়ডে পিকাসোর সৃষ্টিতে মেডিটেরিয়ানের অনেক প্রভাব পড়ে। বলা যায় শান্ত সহজ সরল এন্টিবের জীবন যাপন, রোমান দুর্গ, সমুদ্র সবই ছিল সেই সময়ে পিকাসোর প্রেরণা। শুধু সমুদ্র নয়, অনেক ছবিতেই সেই সময়ে পিকাসোর মেজাজ ধরা পড়েছে।
শুধু যে পিকাসোর সৃষ্টিই এই শহরে টুরিস্ট আকর্ষণ করে তা নয়। এই শহরের নোনা বাতাসেও যেন এক নিজস্ব আবেদন আছে, তাই তো পিকাসোর মত বিরাট শিল্পীকে এই ছোট্ট শহর আকর্ষণ করেছে।
এই শহরের একটু দূরে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম সামুদ্রিক প্রাণীর পার্ক ও মিউজিয়াম – Marineland। বছরে প্রায় দেড় লক্ষ টুরিস্ট শুধু এই Marineland এ আসে। killer whales ও dolphins এর খেলা দেখতে ভিড় করে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই। অন্য আরও অনেক সামুদ্রিক প্রাণী এখানে থাকে। সুদূর আন্টারটিকার পেঙ্গুইনের পরিবারও দেখছি আছে।
মাছ খেকো, গম্ভীর মুখো, গুঁফো শীল মাছেরা মাছ খেতে খেতে খেলা দেখিয়ে চলেছে। এক একটা শোএ বালতি বালতি মাছ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মাছ খাওয়া শেষ হলেই গায়ের চামড়া ভিজিয়ে নিতে বুকে হেঁটে জলে ঝাঁপ দিচ্ছে।
ডলফিনের ট্রেনারদের মুখে কি ভালবাসা ডলফিনের প্রতি, খেলা দেখানোর সময়ে সর্বদা হেসে ডলফিনদের নির্দেশনা করছে। কতো যত্ন নিয়ে ওরা ট্রেনিং দিয়েছে এই সামুদ্রিক প্রাণীদের। ডলফিনরাও যেন সমস্ত কথা বুঝতে পারছে, ভালোবাসার ভাষা সামুদ্রিক অবলা প্রাণীও যে বুঝতে পারে।
মারাত্মক killer whale রা বিশাল শরীর নিয়ে খেলা দেখিয়ে বার বার ট্রেনারদের কাছে ফিরে যাচ্ছে। ওরা killer whale এর মুখে মাছ দিচ্ছে আর চামড়া ঘষে দিচ্ছে। আবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে খেলা দেখাচ্ছে জলের দৈত্যরা। এখানে যতজন প্রাণী ততজন ট্রেনার।
killer whale ও ডলফিনের খেলা শেষ হলে সমুদ্র সুড়ুঙ্গে ঢুকে চারিপাশ থেকে সমুদ্র অনুভব করা যায়। মাথার উপর দিয়ে চলে যায় বিরাট হাঙর, এক ঝাঁক সামুদ্রিক মাছ। সামুদ্রিক প্রাণীদের মাথার উপরে আনাগোনা ও সল্প আলোতে মনে হয় যেন সমুদ্রের নীচে চলে এসেছি।
কয়েকশো বছরের বয়স্ক কচ্ছপ, অক্টোপাস, ভয়ংকর পিরানহা মাছ – শুনেছি এক ঝাঁক পিরানহা একটা প্রাপ্তবয়স্ক ঘোড়াকে নিমেষে খেয়ে শেষ করে দেয়, জেলি ফিশ, শঙ্কর মাছ, তরোয়াল মাছ, হাঙর, অদ্ভুত ছোট ছোট সামুদ্রিক মাছ – কি নেই এখানে! সমুদ্রের সমস্ত কিম্ভূত প্রাণীরা এখানে আছে।
অনেক জায়গা ঘেরা এই মেরিনল্যান্ডে সারাদিন সামুদ্রিক নোনা ভাবে কেটে যায়। উপরে যে সমুদ্র শান্ত, কখনো বা উত্তাল তার গভীরে যে সম্পূর্ণ অন্যরকম অদ্ভুত এক অজানা জগৎ সমান্তরাল ভাবে বয়ে চলেছে, এখানে না এলে বোধহয় এতো সহজে বুঝতে পারতাম না।
ফেরার সময় মেরিনল্যান্ডের ঠিক বাইরেই দেখি এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা অনেক বেড়ালকে খাবার দিচ্ছেন। প্রতিটি বেড়ালের জন্যে আলাদা এলুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়িয়ে আলাদা খাবার এনেছেন তিনি, বেড়ালদের ঝগড়া এড়ানোর জন্যে। তাই শান্ত হয়ে প্রতিটি বেড়াল নিজের খাবার খাচ্ছে। প্রতিটি বেড়ালই বেশ মোটা, মনে হয় ভদ্রমহিলা নিয়মিত এই বেড়ালদের খাবার খাওয়ান, বেড়াল গুলোর সঙ্গে ওনার বেশ ভাব দেখলাম। বিনা টিকিটের এই শো অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখছে।
এ কি শুধুই বিনোদন? মনে হয় না। পৃথিবীটা যে শুধু মানুষের বাসস্থান নয়, অন্য প্রাণীদেরও অধিকার এই পৃথিবীর জল, মাটি, হাওয়ায় সেটাই যেন বুঝিয়ে দেয় এই মেরিনল্যান্ড। একে অন্যকে চিনে, বুঝে, ভালোবেসে শান্তি পূর্ণ সহাবস্থানই যে আজকের সভ্যতার উদ্দ্যেশ্য তারই যেন দৃষ্টান্ত এই মেরিনল্যান্ড।