পারফিউম নগরী গ্রাস (Grasse, France)

            February 2009, Grasse, France

STD_0710

এখানে মিষ্টি বাতাস মাতাল সুগন্ধে ভরা। এই শান্ত, নির্জন,সবুজ, পাহাড়ি গ্রাম-নগরীর বিশুদ্ধ বাতাসে ভাসে ফরাসী পারফিউমের সৌরভ। তাই এই গ্রামে বাস থেকে নেমেই বুক ভরে শ্বাস নি।

নিস (Nice) থেকে বাসে মাত্র দেড় ঘণ্টার দূরত্বে ফরাসী পারফিউম তৈরির নগরী গ্রাস (Grasse)।

কয়েকশো বছরের পুরনো এই গ্রামটিতে ১৬ শতকেই পারফিউম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠে।

STB_0708-001 gras

এই শহর ফরাসী পারফিউমের রাজধানী। শতাব্দী কাল ধরে, ফ্রান্সের রাজা-রানির সময় থেকে এই গ্রামে ফরাসী পারফিউম তৈরি হয়ে এসেছে। বলা হয় ফ্রান্সের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত পারফিউমের স্বর্গীয়, মোহময় সুগন্ধের জন্ম এই ছোট শহরে।

বাজারে এখন পারফিউম তৈরির অনেক আধুনিক উপায়, অনেক আধুনিক রসায়ন চলে এসেছে। কিন্তু, এখানের অনেক পারফিউমারিতে আজও সেই আদিম পদ্ধতিতে পারফিউম তৈরি হয়।

IMG_0713-001

প্রায় ষাটটিরও বেশী বড় কোম্পানির পারফিউমারি আছে এখানে। এই গ্রামের প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাসিন্দার মধ্যে প্রায় দশ হাজার বাসিন্দা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পারফিউম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত।

অনেক পারফিউমারিতেই টুরিস্টদের জন্য ট্যুর থাকে। পারফিউম বিশেষজ্ঞ গাইড টুরিস্টদের ঘুরিয়ে দেখায় পারফিউম ফ্যাক্টরির ভেতর, বলে দেয় পারফিউম তৈরির ইতিহাস ও অবশেষে পারফিউমের শো রুমে ইচ্ছে মত পারফিউম কেনাকাটি করার স্বাধীনতা দেয়।

আমরা যখন পৌঁছলাম গ্রাসে, এখানের শতাব্দী পুরনো Galimard পারফিউমারিতে প্রচণ্ড ভিড়। নিসে কার্নিভ্যাল উপলক্ষে যে টুরিস্ট এসেছে, অনেকে এখানেও চলে এসেছে। Galimard পারফিউমারি স্থাপিত হয় ১৭৪৭ সালে, তাই ঐতিহাসিকতার দিক থেকে এই পারফিউমারির আকর্ষণ অনেক বেশী। স্প্যানিশ, ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় ট্যুর হয় এখানে।

IMG_0733-001

Galimard এর ট্যুর শেষ করে আমরা চললাম Fragonard Musée du Parfum  পারফিউমারির উদ্দ্যেশ্যে। Fragonard  পারফিউমারি বয়সে একটু যুবক। ১৯ শতকের শুরুতে যখন পারফিউম ইন্ডাস্ট্রির পদ্ধতি গুলো নবীকরণ হল, ফুলের নির্যাসের সুগন্ধের পাশাপাশি নতুন রসায়নবিদ্যা আরও নতুন নতুন সুগন্ধের খোঁজ দিল – সেই সময়ে Fragonard  পারফিউমারির স্থাপন হয়।

Fragonard  পারফিউমারিতে ঢোকার মুখে বিশাল তামার পাত্র রাখা, বহু আগে পারফিউম ফিল্টার করার জন্যে ব্যাবহার হত।

IMG_0717

Fragonard  পারফিউমারিতে ঢুকেই ডানদিকে দেখি বিশাল এক পোস্টার – কোন কোন দেশ থেকে ফরাসী সুগন্ধি তৈরির কাঁচা মাল আসে তার এক চার্ট। যথারীতি দেশের নামটি খোঁজার চেষ্টা করলাম সেই চার্ট থেকে। হুম, খুঁজে পেলাম- ‘santal’ মানে চন্দন ও ‘Tubereuse’ মানে রজনীগন্ধা আসে আমাদের দেশ থেকে। শ্রীলঙ্কা থেকে আসে দারুচিনি। আরও অনেক দেশের নাম আছে এই চার্টে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নানান ফুলের সুগন্ধি নির্যাস বের করে – মিলিয়ে এক একটি দামী পারফিউম তৈরি হয়।

IMG_0718-001 IMG_0719IMG_0731

ফরাসী পারফিউম তৈরির জন্যে প্রচুর ফুলের জোগান চাই, যেমন, একশো কেজি গোলাপ থেকে মাত্র এক লিটার পারফিউম তৈরি হতে পারে। ফ্রেঞ্চ রিভেইরার গ্রাসের এই পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর ফুল হয় তাই এই ছোট গ্রামটি পারফিউমারি তৈরির জন্যে উপযুক্ত ছিল এবং এখনো উপযুক্ত।

Fragonard এ আমাদের ট্যুর গাইড এক স্প্যানিশ মেয়ে। সে বলছিল, ফ্রান্সে নাকি কয়েকজন পারফিউমের সুগন্ধ বিশেষজ্ঞ আছেন যারা গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারেন পারফিউমের তিনটে Notes এর গন্ধ, কোন Notes এ কি কি ফুলের নির্যাস আছে সেটাও নাকি বলে দিতে পারেন তাঁরা।

IMG_0721

এক এক কোম্পানির গন্ধবিচারের এই বিশেষ দল নাকি ঠিক করে বছরের বিশেষ পারফিউমের বিশেষ গন্ধ, তাঁরাই ঠিক করেন কি কি ফুলের নির্যাস দিয়ে পারফিউম তৈরি হবে।

আর সেই পারফিউম তৈরির ফর্মুলা গোপনে ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোজিট ভল্টে থাকে।

সেই সুগন্ধ বিচারকদের নাকের ইনস্যুরেন্স করা থাকে, আদর করে ফ্রেঞ্চে তাঁদের বলে ‘le nez’ । অতীতের পারফিউমারির মালিকদের মধ্যে এই বিশেষ প্রতিভা বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হত।

IMG_0715

Fragonard এর পারফিউম তৈরির ইতিহাস, অতীত ও বর্তমান ব্যবস্থা দেখা শেষ হলে Fragonard পারফিউমের বিশাল শো রুমে চলে এলাম। এবার ফরাসী পারফিউম শোঁকার ও কেনার পালা। নানান পারফিউমের গন্ধ শুঁকে পারফিউমের গোরার কথা জেনে নিলাম। জানলাম Fragonard পারফিউমের গন্ধের জীবনকাল বাড়াতে এলুমিনিয়ামের বোতলে রাখে। কাচের বোতলে সূর্যের আলোর সংস্পর্শে নাকি পারফিউমের গন্ধ উবে যায়। কি মুশকিল! যে পারফিউমের গন্ধ শুঁকি তাই মোহময় বলে মনে হয়। নানান অপরূপ সুগন্ধের ভিড়ে দিশাহারা হয়ে স্প্যানিশ মেয়েটির সাহায্য নিয়ে কয়েক বোতল Fragonard পারফিউম সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম।

 STC_0709-001Fragonard এর সেই মাতাল করা সুগন্ধ যেন আমার অবচেতনে গেঁথে গেছে। আজও ফ্রান্সের ভিড় মেট্রো বা বাসে ফ্রেঞ্চ মহিলাদের মাখা Fragonard এর সেই সুগন্ধ হঠাৎ নাকে গেলে আমার চেতনা যেন অবশ হয়, মন যেন এক মোহ-আবেশে জড় হয়ে যায়। মন এক ছুটে সেই শান্ত, নিবিড়, পাহাড়ি গ্রাস গ্রামে চলে যায়, যে গ্রামের বাতাসে ভাসে ফরাসী পারফিউমের সৌরভ। গ্রাস গ্রাম আমার স্মৃতি-সুগন্ধি গ্রাম। বুক ভরে শ্বাস টেনে সুগন্ধ ভরে নিই ফুসফুসে।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel and tagged , , , , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s