December 2011, Midi-Pyrénées, France
‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। তবে যেই আঁকুক সে কেবল ছবিই আঁকে…।’ আর সেই ছবি আঁকতে আঁকতে জীবন বেলা অবেলার দিকে যাত্রা করে। কিছু ছবি অমলিন থাকে। আমার স্মৃতির পটে পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্যের ছবি অমলিন। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু সৌন্দর্য দেখেছি যার ছাপ সারা জীবন থেকে যাবে।
মিদিপিরিনিস পাহাড় শ্রেণীর কোলে ছোট্ট এক নিঃসঙ্গ, নির্জন, নিঝুম পাহাড়ি গ্রাম গুজেত। ডিসেম্বর মাস। মিদিপিরিনিস পাহাড় শ্রেণী সাদা বরফে ঢাকা। চারিদিকে সাদা তুষার। সারা রাত ধরে তুষার পাত হয়েছে। এবার এখানে খুব তুষারপাত হয়েছে। এখানের লোকেরা বলছে গত পনেরো বছরের মধ্যে এখানে এতো তুষার পাত হয়নি কখনও।
গুজেত এক ছোট্ট স্কি ষ্টেশন। সাধারনত এই গ্রামে তুষারপাতের সময় আরও পরে শুরু হয়। আল্পসের তুষারের প্রভাব এখানে আসতে আসতে প্রায় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি হয়ে যায়। কিন্তু, এবারের প্রকৃতির খেয়াল অন্যরকম। এবার তাই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়েই গুজেত বরফে ঢাকা।
এই গ্রামে লোকবসতি খুব কম। যাও বা লোক আছে এই ঠাণ্ডার সময়ে কেউই ঘর ছেড়ে বেরোয় না। এক অদ্ভুত নির্জনতা এই গ্রামের বুকে। এখানে শীতের দিনের দৈর্ঘ্য একেই ছোট আবার পাহাড়ের ছায়া পড়ে খুব তাড়াতাড়িই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। সন্ধ্যা নামা মাত্রই তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের অনেক নিচে। বাইরে থাকাই মুশকিল তখন।
এখানে আমরা এসে পৌঁছেছি শুক্রবারের শেষ বিকেলে। মিদিপিরিনিস পাহাড় শ্রেণীর ঐ পারে সূর্য তখন লাল রঙ ছড়াতে শুরু করেছে, তাঁর আভা পড়েছে পাহাড়ের উপরে জমে থাকা বরফের উপরে। বরফের গায়েও সূর্যের লাল লালিমা ছড়িয়েছে।
আমরা যে বাড়ীটায় থাকবো সেটা সম্পূর্ণ কাঠের। বাড়ীর নাম ‘সাম্বালা’। বাড়ীটা পাহাড়ের গায়ে একা দাঁড়িয়ে আছে।
শেষ বিকেলের আলোতে বাড়িটিও যেন স্নান করে সেজে নিচ্ছিল। সাদা পাহাড়ের গায়ে সারা গায়ে বরফ জড়িয়ে কাঠের বাড়িটিকে এক খেলনা বাড়ীর মতোই মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন ছবি এঁকে রেখেছে। গাড়ীর রাস্তা থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে একটু উপরে উঠে বাড়িটিতে যেতে হয়।
গাড়ি থেকে নেমে জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িটিতে পৌঁছতে পৌঁছতেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেল।
বছরের অন্য সময়ে এই বাড়িটিতে কেউ থাকে না। শুধু স্কি এর সময়েই এই গ্রামে লোক সমাগম হয়। এখানে আমাদেরই রান্না করতে হবে। আমরা রান্নার সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে এসেছি সঙ্গে করে। ‘সাম্বালা’র যাওয়ার রাস্তায় কোমর সমান তুষার জমে আছে। প্রথমেই সেই কোমর সমান তুষার বেলচা দিয়ে কেটে কেটে পরিষ্কার করে রাস্তা বানানো হল।
আমারা ছয়জন এসেছি এখানে। অনেক পরিশ্রমের কাজ বরফ কাটা। তুষার সরিয়ে রাস্তা তৈরি করে ঘরে ঢুকে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। মোটা গ্লাভস ভেদ করে ঠাণ্ডা লাগছে হাতে।
সবার দাবি ‘চা’। এখানে ঘর গরম করার জন্যে Fire place এ কাঠ জ্বালাতে হবে। চা, খাবার ইত্যাদি তৈরি করার জন্যে ইলেকট্রিক হিটার। অগত্যা চায়ের তোড়জোড় শুরু হল। কয়েকজন লেগে গেল ফায়ার প্লেসের আগুন জ্বালাতে।
কল খুলে জল নিতে গিয়ে দেখি জল আসছে না। পাইপের জল জমে বরফ হয়ে গেছে। নিয়মে কলের জল যাতে বরফ না হয় সে ব্যবস্থা করা থাকে, কিন্তু বহুদিন ব্যাবহার না করায় জল জমে গেছে। এই গ্রামে শীতে খুব বেশি লোকজন থাকে না কিন্তু সরকারের তরফ থেকে সমস্ত কিছু দেখাশোনার দায়িত্বে থাকে স্থানীয় কিছু লোক। যাইহোক, এই মারাত্মক শীতের সন্ধ্যায় সেই সাহায্য কখন আসবে জানা নেই তবুও ফোন করা হল।
বাইরে রাশি রাশি তুষারের স্তূপ। ঠিক করলাম আজ তুষার গলিয়েই চা করে খাব। সবাই মিলে অনেক তুষার নিয়ে এসে চায়ের জলের বন্দোবস্ত হল।
অদ্ভুত এক অনুভূতি। এইরকম কাঠের বাড়ী, এই রকম পরিবেশ, ফায়ার প্লেসে আগুন, এইরকম সৌন্দর্য শুধু ছবিতেই দেখেছি। বাস্তবে অনুভব করতে পেরে অভিভূত হয়ে গেছি। বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস সতেরো।
বাইরে জমাট ঠাণ্ডা। রান্না ঘরে হিটার জ্বালিয়ে চা তৈরি হচ্ছে। হঠাৎ রান্না ঘরের কাঠের জানালার বাইরে শুনি খচ খচ শব্দ। ভয় হল। এই জনবসতি বিরল আদিম সৌন্দর্যের দেশে এই রাতে কে?
এখানে জানালার দু’টো পরত, ভেতরে কাঠের পাল্লা – ভেতরের দিকে খোলে। বাইরে কাচের পাল্লা – বাইরের দিকে খোলে। ভয়ে ভয়ে ভেতরের কাঠের পাল্লা খুলে কাচের জানালা দিয়ে তাকালাম।
ওমা, মার্জার পরিবার যে! এই ঠাণ্ডায় মানুষের আওয়াজ পেয়ে পরিবার নিয়ে চলে এসেছে একটু উষ্ণতার খোঁজে, একটু খাবারের আশায়। এই মার্জার পরিবারের সবাই খুব সুন্দর, কেউ মিশকালো, কেউ বাদামি, কেউ বা আবার সাদা কালো ছোপ ছোপ।
আমরা বাটি ভর্তি করে গরম দুধ দিলাম সঙ্গে সঙ্গে। এই ঠাণ্ডায় ওরাও জানে গরম দুধ খুব বেশি সময় গরম থাকবে না, তাই দুধ দেওয়া মাত্র সবাই ঝাপিয়ে পরে দুধের বাটি শেষ করে দিল।
সেই সন্ধ্যায় আমাদের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো এই মার্জার পরিবার। কি ভাবে এই ঠাণ্ডার দেশে এরা বেঁচে আছে সেই নিয়ে শুরু হল হালকা গবেষণা।
গরম চায়ে চুমুক, ফায়ার প্লেসের উষ্ণতা আড্ডা জমিয়ে তুলল। আড্ডার বিষয় শুধু যে মার্জার প্রজাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, পরের দিনে কি করা হবে কোথায় যাওয়া হবে সে নিয়েও আলোচনা চলল।
রাত নামে। নির্জন এই গ্রাম আরও নির্জন হয়ে যায়। আমরা জানতাম না, সেদিন আবার পূর্ণিমা।
রাতের সৌন্দর্য দেখতে বাইরে বেড়িয়ে দেখি মিদিপিরিনিসের তুষারে ঢাকা সাদা পাহাড় শ্রেণীর বুকে চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়েছে। এই পৃথিবীতে পূর্ণিমার রাত অনেক দেখেছি। চাঁদের আলোয় মায়াবী পৃথিবীর রোম্যান্টিকতা অনেক দেখেছি, কিন্তু, এই পরিবেশে দেশ থেকে বহু দূরে মিদিপিরিনিস পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম গুজেত পূর্ণিমার আলোয় এত সুন্দর সাজতে পারে তা কোনদিনও কল্পনা করি নি। জমাট ঠাণ্ডায় সারা গ্রাম নিঝুম।
নির্জনতার বুঝি বা এক শব্দ আছে। কান পেতে সেই নির্জনতার শব্দ শুনতে বহুক্ষণ ধরে কাঠের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। রাত তিনটে বাজে। চা বানিয়ে নিয়ে বাইরে মাইনাস সতেরো ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে চুমুক দিতে দিতে এই অতীব সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
ফ্রান্সে এসে আগে কখনো নিকষ কালো অন্ধকার দেখি নি। রাতের তারারা ফ্রান্সের শহরের নিউক্লিয়ার শক্তির আলোয় লজ্জায় মুখ ঢাকে।
পাহাড়ের ছায়ায় এই নিকষ কালো অন্ধকার, আকাশ ভরা তারা, পূর্ণিমার আলো, রাতের মিদিপিরিনিসের ধূসর সাদা পাহাড় শ্রেণী যেন এক স্বপ্নের পৃথিবীতে নিয়ে গেছে। যে পৃথিবীতে নেই কোন হানাহানি, নেই চিন্তা, নেই হিংসা – আছে শুধু প্রকৃতির নীরব শান্তি, আছে শীতলতা, আছে অসীম ধৈর্য, আছে স্থিরতা।
কি যে গভীর শান্তি এই গভীর ঠাণ্ডা অন্ধকারে। এই শান্ত স্তব্ধ প্রকৃতির কোলে অনন্ত কাল থেকে যেতে মন চায়, এই নির্জনতায় যেন এক আত্মোপলব্ধি হয়। কিন্তু, আমরা শহুরে কেজো প্রাণী সকাল হলেই শহর মুখি হবো, রাজ্যের কাজ ভিড় করবে প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় – এটাই বাস্তব। তবে কাজের ফাঁকে মনের ছুটিতে বার বার মিদিপিরিনিস পাহাড়ের এই নীরব পূর্ণিমা রাতের সৌন্দর্য ফিরে ফিরে আসবে স্মৃতি পটে। এ ছবি হয়ে থাকবে অমলিন।
Cool photographs….
Thank you…