বাতাসে কেমন এক অনুভূতি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। এখানে এখন বাতাসের ছোঁয়ায় একটু শীতের পরশ, রোদের রং কাঁচা হলুদ, তেজ মৃদু। আমার বেলকনির টবের মাটিগুলো এই সামারের রোদের তেজে শুকিয়ে গিয়েছিল। হলুদ গাদা গুলো মরে গিয়েছিল। কাল আমি আবার নতুন মাটি দিয়ে আবার নতুন বীজ ফেললাম।
সন্ধ্যা এখানে এখন এক অদ্ভূত অনুভূতি দেয়, ঠিক যেমন ছেলেবেলায় কালিপূজোর আগে ঠান্ডা পরার সময় হাওয়ায় এক শীত শীত অনুভূতি থাকত ঠিক তেমনি। রোদের তেজে থাকত এক নরম পরশ।
ইউরোপের প্রকৃতি তো সুন্দর, বোধহয় আরও বেশী সুন্দর দক্ষিণ ফ্রান্সের প্রকৃতি। এখানের প্রতিদিনের প্রকৃতি যেন কবিতার ছন্দ, প্রতিদিনের আকাশে যেন শিল্পীর তুলির রঙের আঁকিবুঁকি। উঁচু নিচু সবুজ- হলুদ মাঠে স্বপ্নের গোলক ধাঁধা।
সকালের প্রথম সূর্য যখন সামনের টিলার টালির বাড়িগুলোর উপরে পড়ে অদ্ভূত এক রঙের খেলা তৈরী হয়।
তুলুসে দিন চলে নিজের ছন্দে। শনিবারে কাঁচা সোনা রোদ উঠেছে। আমাদের বাড়ীর নীচে এক সদা ব্যস্ত আধা-শহুরে জীবন যাত্রা চোখে পড়ে। এপ্রিলের মাঝামঝি সময়ে এখানে চারিদিকে সাদা, গোলাপি হলুদ ফুলের জয় জয়কার।
আমরা যেখানে থাকি আমি বলি ‘রামোন ভিলে’ (Ramon ville) কিন্তু ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে বলতে হয় ‘রামো ভি’, এখানে খুব ভিড় নেই, একটু ফাঁকা ফাঁকা, প্রচুর বড় গাছ গাছড়া। এখন আবার চেরি গাছেরাও চেরি ফল দেওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে ডালে ডালে সাদা ফুলের পসরা সাজিয়ে। শীত চলে যাওয়ার ঠিক পরেই এই সাদা ফুল ফোটে, সুন্দর হয়ে যায় চারিদিক। পরিবেশ উষ্ণ হলেও চেরি গাছের ডালে শীত যেন তার তুষার কণা দিয়ে যায়।
আমাদের বাড়ীর ঠিক নিচেই আছে তাজা সবজির দোকান, ফ্রেঞ্চ Red Wine Nicolas এর দোকান।
আর উলটো দিকে আছে ফুলের দোকান তার মালিক আবার দুই নারী, সদা ব্যস্ত দুই নারীকে প্রায়ই দেখি ফুল সাজায়, ফুল গাছে জল দেয়। কখনো দেখি বিয়ের জন্যে ভিন্টেজ গাড়ি সাজাতে ব্যাস্ত দুজনে।
আর আছে ফ্রেঞ্চ ব্রেডের দোকান Boulangerie ও Pâtisserie। সকাল হলেই প্রতিদিন ওদের দোকানের পেছনের রান্নাঘরের চিমনি দিয়ে সাদা ধোঁয়া আর চারিদিকের ফ্রেঞ্চ ব্রেডের সুবাস জানিয়ে দেয় ওদের ব্রেড তৈরি, দোকান খুলে দেয়, ফ্রেঞ্চরা প্রাতঃরাশের ব্রেড ও ক্রসো (Croissant) কিনতে ভিড় করে Boulangerie তে। বাঙ্গালি যেমন রসগোল্লার প্রতি দুর্বল তেমনি ফ্রেঞ্চরা ফ্রেঞ্চ ব্রেডের প্রতি সংবেদনশীল।
ফ্রেঞ্চ ব্রেডের দোকানের ঠিক সামনেই এক ভিখারি তার কালো কুকুর নিয়ে বসে, কুকুর সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব রাখে। ভিখারিটি মাঝ বয়সী যুবক, মাথা নিচু করে কখনো সকালের খবর কাগজ পড়ে, কখনো বা সুডুকুর বই সমাধান করে বা কখনো গিটার বাজিয়ে লোকসঙ্গীত গায়। ভিড় জমে বয়স্ক নরনারীর, কেউ বা গান শোনে আবার কেউ কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কেউ কেউ তো কুকুরকে খাবারও কিনে দেয়। অনেকদিন দেখেছি এখানের ভদ্রলোকেরা ভিখারিটিকে পাঁচ ইউরো বা দশ ইউরো দিয়ে হ্যান্ড শেক করে। ভিখারিটির ব্যাবহারে বিন্দুমাত্র ভিক্ষার গ্লানি নেই। জানি না কেন। কিন্তু, শীতকালে যখন দেখি মাইনাস পাঁচ ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে বসে আছে আর কুকুরটিও গোল হয়ে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে চাইছে তখন করুণা হয়।
কখনো কখনো শান্ত এই শহর-তলি ছোট খাটো কারনিভ্যেলে একটু সরগরম হয়। দিন বয়ে যায় এই আধ-শহরে। কত স্মৃতি জমা হয় জীবনের খাতায়।