কতরূপে ক্যানাল ডু মিদি ….
এখানে আমাদের বাড়ির চারপাশে প্রচুর গাছ। বাড়ি থেকে কিছু দুরে হেটে গেলেই এক ক্যানাল, নাম ‘ক্যানাল ডু মিদি’ (Canal du Midi)।
‘ক্যানাল দু মিদি’ ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইটের মধ্যে চলে আসে ১৯৯৬ সালে। বিখ্যাত এই ক্যানালকে তুলুসে আসার পর থেকেই দেখছি। দেখেছি এই ক্যানাল ঘিরে তুলুসের জীবন ছবি। এই ক্যানালকে তুলুসের ‘ফুসফুস’ বললে খুব ভুল বলা হবে না। প্রচুর Plane গাছ এই ক্যানালের ধারে ধারে। প্রায় দুশো চল্লিশ কিলোমিটার এই ক্যানালের ধারে ধারে এই গাছের সারি লাগানো।
‘ক্যানাল দু মিডি’ ফ্রান্সের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে বয়ে চলেছে, তুলুসে এই ক্যানালের কিছু অংশ পড়ে, ফ্রেঞ্চ ইঞ্জিনিয়ারিং এবং শিল্পের মহৎ নিদর্শণ এই ক্যানাল। এই ক্যানালে ৯১ টা লক আছে যা কিনা ১৯০ মিটার জলের ওঠা নামা করাতে পারে। ‘ক্যানাল দু মিডি’ বাংলায় মানে করলে দাঁড়ায় দুই সমুদ্রের মাঝের ক্যানাল। দক্ষিণ ফ্রান্সের এই দু’শো চল্লিশ কিলোমিটার লম্বা ক্যানাল ১৬৬৬ সালে আটলান্টিক এবং মেডিটেরিয়ানের মধ্যে শর্টকাট জলপথ বানানোর জন্য তৈরি হয়।
কেনই বা এতো বড় ক্যানাল তৈরি হল? স্পেন ঘুরে লম্বা সমুদ্রযাত্রা কম করার জন্যে, সময় বাঁচাবার জন্যে, জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে, ব্যবসা বানিজ্যের সুবিধার জন্যে এত বড় ক্যনাল বানানো হয়। তখনকার সময় এই ক্যনাল দিয়ে সিল্ক, ফ্রান্সের বরদু এলাকার বিখ্যাত ওয়াইন রপ্তানি হত। এই ক্যানালের সঙ্গে তুলুসের নদী ‘গ্যারন’-এর জল এসে মিশেছে।
রেল লাইন তৈরী হওয়ার পরে এই ক্যানালের ব্যাবহার ধীরে ধীরে কমে যায় কিন্তু এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোন কার্যক্ষম ক্যানালের মধ্যে অন্যতম এই ‘ক্যানাল দু মিডি’। এখনও ক্যানালের জলে লাল নীল সবুজ হলুদ হাউসবোট ভাসে সারাবছর, গরমের সময় অনেকেই ওই হাউসবোট গুলো নিয়ে পাড়ি দেয় আটলান্টিক বা মেডিটেরিয়ান।
ক্যানালের দুই ধারে সুন্দর রাস্তা আর রাস্তার দুধারে সার বেধে ‘প্লান ট্রি’ (platanus) লাগানো। ক্যানালের ধারের মনোরম ছায়াসুনিবীর রাস্তা ধরে সারা বছর ধরে তুলুসের স্বাস্থ্য প্রেমীদের দিন কাটে – দৌড়নো, সাইকেল চালানো চলে সারা বছর। শুধু যে স্বাস্থ্য প্রেমী দের দিন কাটে তা নয় সুদৃশ্য এই ক্যানালের ধারে টুর ডে ফ্রান্সের সাইকেল চালানো প্র্যাকটিস করার জন্যে ভাল রাস্তা করা আছে।
ক্যানাল দু মিদির জলে ভাসে রেস্তোরাঁ, স্পা। পুরো ক্যানাল ধরে জলপথে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে বোট। ক্যানালের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই অনেক দূর, দেখা যায় সূর্যমুখী ফুলের চাষের জমি। নীল আকাশ আর হলুদ জমি এক অসাধারণ ছবি তৈরি করে।
নানা সময়ে এই ক্যানালের নানা রূপ দেখেছি। গরমের সময়ে দেখেছি সারি বাধা সবুজ গাছ গুলো এক ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ তৈরি করেছে।
আবার অক্টোবরে পাতাঝরার সময়ে দেখেছি আগুনরঙ্গা ক্যানাল দু মিদি, এ যেন “স্থলে জলে বন তলে লাগলো যে দোল…’’ । শীত শুরুর সময়ে দেখেছি ক্যানালের পাশের সারি বাধা সব গাছের পাতা ঝরিয়ে শুকনো ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা উদাসি, বৈরাগী রূপ। ডিসেম্বরের তুষার পাতের পরে দেখেছি সাদা বরফের চাদরে মুড়ে জবুথবু ক্যানাল দু মিদিকে, জলে ভাসতে দেখেছি বরফের পাতলা চাদর।
একবার শোনা গেল, ক্যানাল দুমিদির সমস্ত গাছ কেটে দেওয়া হবে, এই গাছ গুলোর যেন কি এক সংক্রামক রোগ হয়েছে। শুনে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। ইউরোপের অন্যতম সুন্দর এই ক্যানালের দু’পাশের গাছই তো অলঙ্কার। কিন্তু, সঠিক সময়ে সমাধান হয়ে গেল। ক্যানালের গাছ যথা স্থানে রয়ে গেল, গাছেদের রোগ সারানো হল।
এই ক্যানালকে নিয়ে কতো চিত্রকর কতো ছবি এঁকেছেন। এই ক্যানালের পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাই বার বার মনে হয় –
‘The woods are lovely, dark, and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.’