ক্যানাল ডু মিদির উৎস সেন্ট ফেরল (Saint-Ferréol)
August 2011, Toulouse, France
এবার আমরা যাব ক্যানাল ডু মিদির উৎসস্থল দেখতে। ২৪০ কিলোমিটার লম্বা ক্যানাল দু মিদি তে গরমের সময়ে জলের প্রয়োজন মেটাতে এবং ক্যানাল ডু মিদির লক (Lock – water transport) গুলোকে সারা বছর কাজ করানোর জন্যে জলের যথেষ্ট উৎস চাই তাই এই কৃত্রিম জলাধার (Bassin de St. Ferréol) তৈরি হয় সতেরো শতকে। তেষট্টি বছর বয়সে Pierre-Paul Riquet এই ক্যানাল ডু মিদির জন্য জলের উৎস এই বেসিন তৈরির প্রকল্প শুরু করেন। ফ্রেঞ্চ ইঞ্জিনিয়ার ও জল বিশারদ François Andréossy সাহায্যে সেন্ট ফেরলের এই বিশাল জলাধার বানানো হয়।
আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে পড়ে এসেছি সেন্ট ফেরল রেভেল গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার। আমরা ভাবলাম পাঁচ কিলোমিটার! হেঁটেই চলে যাব। বাসের অপেক্ষা করলে সেন্ট ফেরল পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে কারণ বাস অনেকক্ষণ পরে, শুরু হল হাঁটা।
এঁকে বেকে পথ চলে গেছে। পাহাড়ি রাস্তা। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি কিন্তু এখন রেভেলের সীমানাই শেষ হয় নি। আমি জেনে এসেছি রেভেল থেকে সেন্ট ফেরল পাঁচ কিলোমিটার কিন্তু রেভেল বাজার থেকে কত দূরে সেটা পড়িনি। রাভেল বাজার থেকে রাভেলের সীমানা শেষ করতেই হাঁটতে হল অনেকক্ষণ । চড়াই রাস্তা, এর মধ্যে খুব চড়া রোদ্র, সঙ্গে জলের বোতল নেই তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
মাঝে মনে হল ফিরে যাই , কিন্তু ফিরে যাওয়াও তো আবার সেই পেছনে ফেলে আসা দীর্ঘ রাস্তা, তাই স্থির হল এগিয়ে যাই, যদি এগিয়ে গিয়ে বাস স্টপ পাই, তাহলে বাসের অপেক্ষা করবো। যত এগিয়ে চলেছি রাস্তার খাড়াই আরো বাড়ছে, হেঁটে চলেছি তো হেঁটেই চলেছি, কোথায় সেন্ট ফেরল?
তবে পথের ক্লান্তি মুছে যাচ্ছে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যে। কখনও পথের দুপাশে ঘন জঙ্গল। কখনও সুন্দর ঘরবাড়ি। কখনও বা ঢালু দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ সবুজ জমি নজর কেড়ে নিচ্ছে। জায়গায় জায়গায় থেমে থেমে ফোটো নিতে নিতে এগিয়ে চলেছি। রাস্তায় জনমানব নেই। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো যে আমরা ঠিক পথে চলছি কিনা তারও উপায় নেই। এখানে সবাই গাড়ি চড়ে। গাড়ির যাত্রীরা এই দু’ই পথচারীকে নিতান্তই অবাক নজরে দেখছে। বাস স্টপ তো নজরেই পড়ছে না, বোধহয় সেন্ট ফেরল আর রেভেলের মধ্যে কোনো বাস স্টপ নেই।
চলতে চলতে একটা জায়গায় এসে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। সামনের পথ দু’দিকে বেঁকে গেছে। আমরা রাস্তার পাশে বসে পড়লাম কোন পথে যাব ঠিক করতে না পেরে।
অনেকক্ষণ বসে আছি কিন্তু কোন জন প্রাণীর দেখা নেই। ভুল রাস্তায় যাওয়ার চেয়ে যে রাস্তায় এসেছি সেই রাস্তা ধরে ফিরে যাওয়াই মনস্থির করে ফেললাম, ঠিক তক্ষুনি দূরে পাহাড়ের বাঁকে দেখা গেল একজন ভদ্রলোক দৌড়ে দৌড়ে এইদিকেই আসছেন, পরনে ট্র্যাক স্যুট, এই ঠা ঠা দুপুরে জগিং করতে বেড়িয়েছেন, এখানে সবাই খুব স্বাস্থ্য সচেতন শরীরকে সুস্থ রাখতে যাবতীয় কসরত করে।
দূরের ভদ্রলোককে দেখে মনে আশার আলো জাগল ভাবলাম, জিজ্ঞাসা করতে হবে সেন্ট ফেরলের রাস্তা কিন্তু ফ্রান্সে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করা আরেক ঝকমারি, ইংরাজি বোঝে না, যদিও বা বুঝে গেল উত্তর দেবে ফ্রেঞ্চে, সেটা তো আরও অবোধ্য। তবু আমাদের দু’জনের ফ্রেঞ্চ ভাষা জ্ঞান একত্র করে প্রশ্ন তৈরি করে রাখলাম।
ভদ্রলোক কাছে এলে সামনের দুই রাস্তা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “বনজু, সেন্ট ফেরল ঊ?” মানে সেন্ট ফেরল কোনদিকে? ভদ্রলোক হেসে একটা উত্তর দিলেন, “ব…জু। লা বা। প্রে দি সি” মানে ঐদিকে কাছেই। বলেই তিনিও দৌড়তে দৌড়তে যেদিকে হাত দেখিয়েছিলেন সে দিকেই চলে গেলেন। বুঝলাম তাঁরও উদ্দ্যেশ্য সেন্ট ফেরল।
আবার শুরু হল হাঁটা নতুন উৎসাহে, নতুন উদ্দীপনায়। ঐ বয়স্ক ভদ্রলোকের দৌড় দেখে প্রেরণা পেয়ে আমরাও আধঘণ্টা হেঁটে পৌঁছে গেলাম সেন্ট ফেরল।
কালো পাহাড়ের (Montagne Noire) পাদদেশে সেন্ট ফেরল, চারিদিকে ৬৭ হেক্টর জঙ্গল এলাকা। কালো পাহাড়ের ঘন জঙ্গল এলাকায় অনেকেই মাউন্তেনিয়ারিং, ট্র্যাকিং, ক্যাম্পিং ইত্যাদি করে। জঙ্গল রক্ষীরা ঘোড়ায় চড়ে এই কালোপাহাড়ের ঘন জঙ্গল পাহারা দেয়। এই জলাধারের জন্যেই সারাবছর ক্যানাল ডু মিদিতে জল থাকে। এই জলাধার তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় চার বছর।
টার্ন নদী থেকে এই জলাধারে জল আসে, শুধু যে টার্ন নদী থেকে জল আসে তা নয়, অ্যাটলান্টিক ও মেডিটেরিয়ান সমুদ্রের কারনে কালো পাহাড়ের নীচে যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হয়। ১৭ শতকে এই দুই প্রাকৃতিক উপাদান কাজে লাগিয়ে এই বিশাল সেন্ট ফেরলের জলাধার তৈরি হয়।
সেন্ট ফেরল প্রকৃত অর্থে পাহাড়-সমুদ্র সৈকত। জঙ্গলের মধ্যে কাঠের তৈরি সুন্দর এক টুরিস্ট অফিস। গরমের দিনে সারাদিন কাটানোর জন্যে সুন্দর জায়গা।