August 2011, Revel, France
এখানে উইক এন্ড মানেই কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাওয়া চাই, এর মধ্যে যদি সামার হয় তাহলে তো রোদ্র উজ্জ্বল দিনে কোথাও বেড়াতে না গেলে যেন পুরো সপ্তাহটাই মাটি হয়।
প্রকৃতির এই অদ্ভুত আবেদন এড়িয়ে তো আর ঘরে বসা যায় না তাই শণিবার ভোরবেলা বেরিয়ে পড়া গেল, উদ্দেশ্য চোদ্দ শতকের পুরনো বাজার ‘রেভেল’। তুলুস থেকে রেভেল ষাট কিলোমিটার, বাসে করে মাত্র দুই ইউরো দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়।
রেভেল গ্রামের প্রধান আকর্ষণ, গথিক স্টাইলে বানানো চার্চ আর বাজার। এই গ্রামের অর্থনীতি কৃষিপ্রধান হলেও ঔষধ বানানো, কাঠের কাজ এদের অর্থনীতিতে সাহায্য করে। তাছাড়া ছোট ছোট টেকনোলজিক্যাল ব্যাবসাও আছে, যেমন- লেজার কাটিং থেকে শুরু করে ছোট হেলিকপ্টারও বানায় এরা।
রেভেলকে দুর্গ শহরও বলা যেতে পারে, চারিদিক থেকে মোটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা পুরো শহরটা। চোদ্দ শতকের রেভেল বিখ্যাত তার শতাব্দী পুরনো বাজারের জন্য, এই বাজার ফ্রান্সের সবচেয়ে সুন্দর বাজার গুলির মধ্যে অন্যতম।
বাজার বসে কাঠের কাঠামোর ছাদের নিচে। এই কাঠের কাঠামো প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো, এখনও অনেক শক্ত পোক্ত। বাজারের মধ্যে ট্যুরিজম অফিস, এখানে এই এক মজার ব্যাপার, যত ছোট গ্রামই হোক না কেন ট্যুরিজম অফিস থাকবেই। কি কি দেখার আছে গ্রামে, চট করে বলে দেবে ওরা, এবং একটা ম্যাপও দিয়ে দেয়।
এই বাজার পুরোপুরি স্থানীয় মানুষের বাজার। ফ্রান্সের গ্রামবাসীরা নিজের খেতের টাটকা শাক সবজি ফল ইত্যাদি এনে বিক্রি করে। শুধু কি শাক সবজি? কি নেই বাজারে টুপি, হাল ফ্যাশনের জামা কাপড়, ইতালির জমকালো মুখোশ, বাচ্চাদের খেলনা থেকে শুরু করে অলিভ, মধু, রসুনের আচার, পায়লা (আমি বলি স্পেনের বিরিয়ানি) হাঁস, মুরগী, ডিম ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী।
আর বিক্রি হচ্ছে ফ্রান্সের বিখ্যাত পাউরুটি ‘ফ্রেঞ্চ ব্রেড’ বা ‘বাগেত’ যা কিনা ফ্রান্সের মানুষের গর্বের পাউরুটি। এদের দাবি এই পাউরুটি পৃথিবী বিখ্যাত, এর স্বাদ অতুলনীয়, এই পাউরুটি বানানোর ফর্মুলা এরা কাউকে দেবে না দেয় নি। প্রায় দেড় হাত লম্বা এই পাউরুটি কিন্তু সত্যিই অপূর্ব খেতে।
স্থানীয় মানুষের বিকি কিনি দেখতে দেখতে মন চলে গেছে দেশের হাটে। পৃথিবীর সমস্ত দেশের মানুষের কেনাবেচার ধরন ও চরিত্র একই রকম। জিনিষ – দেখে, নেড়ে, টিপে তবে কেনে বিচক্ষণ ফ্রেঞ্চরা। সবচেয়ে বেশি বাছাবাছি করে বয়স্ক মানুষেরা।
হাট বসেছে শনিবারে রেভেল গঞ্জে, গায়ের মানুষ বেচে কেনে। এখানের শনিবারের বাজার যেন উৎসবের মত, পুরো পরিবার চলে আসে বাজারে এমনকি বাড়ির কুকুর ও এসেছে বাজার করতে।
দুপুরের মধ্যে বাজারের বিকি কিনি দেখে নিলাম। বাজারের এক কোনে বসেছে গানের আসর। গিটার ভায়োলিন বাজিয়ে একটা ছেলে আর মেয়ে গান গাইছে। সামনে খোলা গিটার রাখার বাক্স- সেখানে টুক টুক করে দশ সেন্ট, কুড়ি সেন্ট, পঞ্চাশ সেন্ট, এক ইউরো পড়ছে। ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের গিটারের বাক্স ভরে উঠেছে খুচরো পয়সায়। বাচ্চারা সামনের সারিতে বসে শুনছে ওদের গান।
মার্কেটং-এর সহজ পাঠ নিতে হলে নিশ্চয় এই বাজারে একবার আসা উচিৎ। সুর করে গান গেয়ে গেয়ে ডাকছে খদ্দেরদের, মুরগি সেজে ডিম বিক্রি করছে, বাচ্চারা যারা বাবা-মা’র সঙ্গে বাজারে এসেছে তারা তো ওই মুরগি ছাড়া অন্য কোথাও ডিম কিনবে না।
বাজারের এক কোনে দেখি দারুণ ভিড়। কি ব্যাপার জানার ইচ্ছে হল। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি সবজি কাটার মেশিন বিক্রি করেছে, কুড়ি ইউরো করে। যে বিক্রি করছে সে ক্রমাগত ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে চলেছে, আর টপাটপ বিক্রি করে চলেছে, যারা কিনছে তারা নিতান্তই গর্বভরে গম্ভীর ভাবে বাক্সটা বগলে ভরে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে, ভাবটা এমন যেন খুব বড় একটা দাঁও মারা গেল।
বাজার প্রায় শেষ হতে চলেছে, ঘড়ির কাঁটা দু’টোর ঘরে, আমাদের খিদেও পেয়েছে, বাজারের উল্টো দিকে সারি সারি কাফেটারিয়া, পিজার দোকান। পিজার দোকানে বসে খেতে খেতে ব্যবসাদারদের বাজার গুটিয়ে নেওয়া দেখছিলাম। আমি চোখ রাখছিলাম যে ছেলে মেয়ে দু’টি গান গাইছিল তাদের দিকে। ওরাও ওদের গিটার, ভায়োলিন গুটিয়ে নিয়ে বাজার সেরে নিল, একটা বড় গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল আর গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।
দেখতে দেখতে বিকি কিনি সেরে হাটের মানুষ চলে গেল। শতাব্দী প্রাচীন হাট একরাশ শূন্যতা নিয়ে আজও মানুষের সমাগমের অপেক্ষায় থাকে।